যশোরে এবার ৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি

ঋতুরাজ বসন্তের আগমন আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে নতুন সাজে সেজেছে প্রকৃতি। বিশেষ এই দিনটিতে ফুলের বিকল্প নেই। ফলে দিবসটি এলেই কয়েকগুণ বেড়ে যায় ফুলের চাহিদা। আর এসব ফুলের চাহিদার ৬০-৭০ ভাগ যোগান দিচ্ছে ফুলের ‘রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীর বাজার’। দিবস দুটিকে ঘিরে এই অঞ্চলের চাষিরা ৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রি করেছেন।
ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ফুলের বাজার শুরু হয়েছে। তবে ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল সবচেয়ে বড় বাজার। ভোর থেকেই বাজারে গোলাপ, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, ভুট্টা কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকা, জিপসিসহ বিভিন্ন ধরনের ফুল নিয়ে গদখালী হাটে হাজির হন চাষিরা। পর্যাপ্ত ফুল উঠায় জমে ওঠে গদখালীর ফুলেরহাট।
এ হাটে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা বেলা ১১টা পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে ফুল কেনেন। তবে এই দুটি দিবসকে সামনে রেখে হাট জমলেও করোনা মহামারির কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় ফুলের কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি ফুলচাষিরা। তাদের দাবি, গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি ফুল তিন থেকে পাঁচ টাকা কম দরে বিক্রি হয়েছে।
এদিকে, ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, করোনার কারণে এ বছর উৎপাদন কম হয়েছে। চাহিদা যেটাই থাক না কেন কৃষকরা দাম ভালো পেয়েছে। সরবরাহ কম থাকায় চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ফুল। এই দাম ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের আগ মুহূর্তে অব্যাহত থাকলে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সারাবছরের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করছেন তারা।
গদখালী ফ্লাওয়ার সোসাইটি সূত্রে জানা যায়, বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসে দেশের বৃহৎ ফুলের পাইকারি বাজার থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রায় ৫ কোটি গোলাপ, জারবেরা ও গ্লাডিওলাসসহ ১২ ধরনের ফুল দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়েছে। এর মধ্যে শনিবার ২ কোটি টাকার উপরে ফুল বিক্রি হয়েছে। এই দিন যেন ছিল ফুলচাষি ও ব্যাপারীদের কাছে সবচেয়ে আনন্দময় এক দিন।
ফুলচাষিরা আশা করছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আরও ৩০-৪০ কোটি টাকা বিক্রি হবে। চাহিদা বাড়ায় প্রভাব পড়েছে দামে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গত পাঁচদিনে ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে জমজমাট ফুল বেচাকেনা হয়েছে। বিশ্ব ভালবাসা দিবস, বসন্তবরণ ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সামনে রেখেই ফুলের চাহিদা বেড়েছে। শনিবার কাকডাকা ভোরে যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের গদখালী বাজার ফুলে ফুলে ভরে যায়। পানিসারা, নবীনগর, হাড়িয়া, পটুয়াপাড়া, টাওরা, শরীফপুর এলাকার চাষিরা হরেক রকমের ফুলের পসরা নিয়ে বসেন।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাইকাররা ভিড় জমান হাটে। ক্রেতা-বিক্রেতার সরব উপস্থিতিতে জমজমাট হয়ে ওঠে ফুলের হাট। বসন্ত আর ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে গত তিনদিনে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয়েছে চায়না গোলাপ। বাজারে এ গোলাপ বিক্রি হয়েছে ১৮-২০ টাকা, যা আগে ছিল ৬-৮ টাকা।
রজনীগন্ধার প্রতি স্টিক বিক্রি হয়েছে সাড়ে ৮-৯ টাকা, যা আগে ছিল ৩-৫ টাকা। গ্লাডিওলাস (রঙিন) বিক্রি হয়েছে ১৪-১৬ টাকা, যা আগে ছিল ৩-৬ টাকা। জারবেরা বিক্রি হয়েছে ১০-১২ টাকা, যা আগে ছিল ৬-৮। গাঁদা ফুল বিক্রি হয়েছে ৩০০-৪০০ টাকা হাজার। যা আগে ছিল দেড় থেকে ২০০ টাকা হাজার। ফুল বাঁধাইয়ের জন্য কামিনীর পাতা বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা আঁটি, যা আগে ছিল ২৫ টাকা। জিপসির আঁটি বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। যা আগে ছিল ২০-২৫ টাকা।
পটুয়াপাড়া গ্রামের ফুলচাষি আলমগীর হোসেন বলেন, গত বছর এই সময় আড়াই লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছিলাম। করোনায় সারাবছর ফুল বিক্রি ছিল না। আশা করছি, সামনের চারটি অনুষ্ঠানে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব। তিন বিঘা জমিতে গোলাপ, দেড় বিঘাতে গ্লাডিওলাস ও ১৫ কাঠা জমিতে গাঁদা ফুল চাষ করেছি।
হাড়িয়া গ্রামের কৃষক মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘দেড় বিঘা জমিতে চীনের লং স্টিক রোজ জাতের গোলাপ ফুলের চাষ এ অঞ্চলে আমিই প্রথম শুরু করেছিলাম। করোনা পরিস্থিতিতে ফুল বিক্রি হয়নি। বাগান পরিচর্যায় খরচও বেড়েছিল। যে কারণে বাগান পরিচর্যা অনেকটা বাদ দিয়েছিলাম। এতে ১০ থেকে ১২ কাঠা জমির গোলাপ গাছ মারা গেছে। তারপরও এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দুই লাখ টাকার গোলাপ ও ৫০ হাজার টাকার গ্লাডিওলাস ফুল বিক্রির আশা করেছি। গত কয়েকদিনে এক লাখ টাকার ফুল বিক্রি করেছি।’
গদখালীর ফুলচাষি ও পাইকারি ফুল ব্যবসায়ী নুরুজ্জামান আলী বলেন, বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবসে গোলাপের আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে গাঁদা ফুলের চাহিদা বেশি থাকে। খুলনা আর পটুয়াখালীর দুই ব্যবসায়ীর ৫ লাখ টাকার ফুল অর্ডার ছিল। খুব ভোরে গদখালী থেকে ফুল কিনে ভোরে একটি পরিবহনে তাদের ফুল পাঠিয়ে দিয়েছি। গত তিনদিন ধরে আমাদের ফুল বেচাকেনা মোটামুটি ভালো হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘গত বছর ইংরেজি বর্ষবরণ, পয়লা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও বাংলা বর্ষবরণ-এই পাঁচটি অনুষ্ঠান ঘিরে যশোরের গদখালী অঞ্চলের কৃষকেরা অন্তত ৫০ কোটি টাকার ফুল বেচাকেনা করেন। গত বছর আমাদের ৭০ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এ বছর আমরা কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে পারছি না। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গত বছরের মতো এ বছর ফুল বেচাবিক্রি ততটা ভালো হবে না। তারপরও ফুলের চাহিদা ভালো থাকলে আমরা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব বলে আশা করছি।’
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র জানান, যশোর জেলার আট উপজেলায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছে। তার মধ্যে ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী-পানিসারার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কৃষক ৬ হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করছেন। এর মধ্যে ২৭২ হেক্টর জমিতে গ্লাডিওলাস, ১৬৫ হেক্টর জমিতে রজনীগন্ধা, ১০৫ হেক্টর জমিতে গোলাপ, ৫৫ হেক্টর জমিতে গাঁদা, ২২ হেক্টর জমিতে জারবেরা এবং ৬ হেক্টর জমিতে অন্যান্য ফুলের চাষ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রতি বছর বিশ্ব ভালোবাসা, বসন্ত উৎসব ও আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সামনে রেখে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকার ফুল বেচা-কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও করোনার কারণে এ বছর কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেনি। তবে আসছে বিভিন্ন দিবসে এ অঞ্চলের কৃষকরা যদি তাদের টার্গেট অনুযায়ী ফুল বিক্রি করতে পারে তাহলে করোনা ও আম্ফানের ধাক্কা কাটিয়ে না উঠতে পারলেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে।
জাহিদ হাসান/এসপি