মা-মেয়ে যখন দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী

মেয়ে সুস্মিতা দাসকে স্কুলে আনা-নেওয়া করতেন মা পুষ্প দাস (২৯)। আট বছরের সুস্মিতা এখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কিন্তু মেয়েকে পড়াতে পারতেন না মা। এই প্রতিবন্ধকতা ঘোচাতে মেয়ের স্কুলে একই শ্রেণীতে ভর্তি হন মা। ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহী নগরীর ছোটবনগ্রাম পশ্চিমপাড়া এলাকার আলো পথে বিদ্যানিকেতনে।
পুষ্প দাস ছোটবনগ্রাম পশ্চিমপাড়া এলাকার সনাতন দাসের স্ত্রী। সনাতন দাস একজন ভ্রাম্যমাণ ফুচকা বিক্রেতা। সংসার চালাতে সেলাইয়ের কাজ শিখছেন পুষ্প। স্বপ্ন মেয়েকে পড়ালেখা শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন।
করোনার কারণে দেশের অন্য সকল প্রতিষ্ঠানের মতো বন্ধ রয়েছে আলো পথে বিদ্যানিকেতন। তাই ক্লাসে যাওয়ার তাড়া নেই মা-মেয়ের। সোমবার সকালে বিদ্যালয়ের পাশে রোদ পোহাতে দেখা যায় এই মা-মেয়েকে।
পুষ্প দাস জানান, নিজে কিছুই জানতাম না। বাচ্চাকে বাড়িতে একটু বর্ণ পরিচয় দেব, সেটুকুও জানতাম না। আলোর পথে বিদ্যানিকেতনে মেয়ের পাশাপাশি আমিও ফ্রিতে লেখাপড়া শিখছি। আমিও পড়ি, আমার সন্তান পড়ে। স্যার-ম্যাডামরা অনেক ভালো। এমনি পড়ান। না পারলে আবার বুঝিয়ে দেন।
তিনি আরও বলেন, তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তির কথা থাকলেও বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে দ্বিতীয় শ্রেণীতে রয়ে গেছি। পাঠশালা বন্ধ থাকায় পড়ালেখারও চর্চা নেই। ফলে সব পড়া ভুলে যেতে বসেছি।
আলোর পথে বিদ্যানিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা আবু জাফর। তিনি জানান, পাঠশালা প্রতিষ্ঠায় ছোটবনগ্রাম পশ্চিমপাড়া কৈইটাপুকুর নতুন বাইপাস মোড়ে তিনি একখণ্ড জমি ইজারা নেন। বাবার পেনশনের টাকায় ২০১৫ সালে তাতে টিনের বেড়া দিয়ে ঘর তোলেন। সব মিলিয়ে এই পাঠশালায় এখন পড়ালেখা করছে ৩৫০ জন শিশু। বাচ্চাদের সঙ্গে সঙ্গে পাঠশালায় অর্ধশতাধিক মা পাঠ নেন। এরা সবাই এলাকার নিম্ন আয়ের মানুষ।
টিনের ছোট ছোট চারটি আলাদা কক্ষে চলে পাঠদান। বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, খালেদ মাসুদ পাইলটের নামে নামকরণ করা হয়েছে কক্ষগুলোর। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে সচেতনতা ও উপদেশমূলক বিভিন্ন বাণী।
ক্রিকেটারদের নামে শ্রেণীকক্ষের নামকরণের কারণ জানতে চাইলে আবু জাফর বলেন, এখানে শিশুরা খেলাধুলা ও আনন্দময় পরিবেশে শেখে। শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় আগ্রহ বাড়াতে ক্রিকেটারদের নামে কক্ষগুলোর নামকরণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, তিন শিফটে এই পাঠশালায় ক্লাশ হয়। সকাল ৮টা থেকে সোয়া ৯ টায় পাঠদান হয় শিশু শ্রেণীর। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পাঠদান চলে। একই শ্রেণীকক্ষে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর পাঠদান।
পাঠশালার জমির ইজারা বাবদ তার বছরে খরচ হয় ২০ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে পাঁচজন শিক্ষককের সম্মানী বাবদ খরচ হয় কিছু অর্থ। নিজের ইলেকট্রনিকস ব্যবসার আয় দিয়েই চালান এই স্কুল।
আবু জাফর, আলোর পথে বিদ্যানিকেতনের প্রতিষ্ঠাতা
এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক আবু জাফর। স্ত্রী কানিজ ফাতেমা প্রথম দিকে আপত্তি করলেও এখন তিনি নিজেই স্বামীর সহযোগী। শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি নিজে তৈরি করেন সিলেবাসের তালিকা। শিট আকারে তুলে দেন শিক্ষার্থীর হাতে।
আবু জাফর নগরীর ছোটবনগ্রাম প্রফেসর পাড়ার মহসীন উল বারীর ছেলে। বাবা ছিলেন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক। ২০০১ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করেন জাফর। এরপর চাকরির পেছনে ছোটেননি। বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে শিশুদের পাঠদান চালিয়ে গেছেন।
২০১৫ সালে বাবার পেনশনের ৫০ হাজার টাকা পান আবু জাফর। মৃত্যুর আগে বাবা উপদেশ দিয়েছিলেন, ‘নিজের ক্ষতি না হয়, এভাবে যতটুকু পারো মানুষের সেবা করবে।’ এই কথা মনে প্রাণে গেঁথে নিয়ে নেমে পড়েন আলো ছড়ানোর আন্দোলনে।
পাঠলাশা শুরুর প্রথম দিকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে বলেও জানান আবু জাফর। তিনি বলেন, এলাকার পরিবেশ নষ্ট হবে-এমন অজুহাতে এলাকায় কেউ বাচ্চাদের পাঠশালার জন্য জমি দিতে চাননি। শেষে সাধু নামে এক ব্যক্তি রাজি হন। বছরে ২০ হাজার টাকা পাঁচ কাঠা জমি ইজারা নিয়ে গড়ে তোলেন পাঠশালা। কিছু হৃদয়বান মানুষ তার এই উদ্যোগে শুরু থেকেই সহায়তা দিচ্ছেন।
জাফর বলেন, চারটি কক্ষে ৩৫০ জন শিক্ষার্থীকে বসার জায়গা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পর্যাপ্ত বেঞ্চও নেই। টাকার অভাবে পাঠশালায় বৈদ্যুতিক সংযোগও নেওয়া হয়নি। তার একার পক্ষে এই উদ্যোগ চালিয়ে নেওয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বানদের তার এই উদ্যোগে সহায়তার আবেদন জানান আবু জাফর।
এসপি