নিরবচ্ছিন্ন দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ভৈরব

কয়েক শ বছর আগে ভৈরব নদকে ঘিরে গড়ে ওঠে বাগেরহাটের শহর-বন্দর। শুরু হয় মানুষের ব্যবসা, বাণিজ্য, বসতি। কিন্তু সে সভ্যতাই এখন ভৈরবের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ময়লা, আবর্জনা আর ক্রমাগত দখল-দূষণে কমে গেছে নদের স্রোতোধারা, পলি জমেছে তলদেশে। নিরবচ্ছিন্ন এমন অত্যাচারে যেন দুঃখের শেষ নেই ভৈরবের।
অভিযোগ রয়েছে, নদের দখল-দূষণ নিয়ে একেবারে উদাসীন স্থানীয় প্রশাসন। রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখল, অবৈধ ভবন নির্মাণ, নদের তীরে ব্যবসায়ীদের ময়লার ভাগাড়সহ নানা কারণে অস্তিত্ব হারাচ্ছে ভৈরব। দীর্ঘদিন পরপর জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযান চালালেও থেমে নেই প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্য।
ভৈরব নদ বাগেরহাট শহরের উত্তর দিক থেকে এসে সুপারিপট্টি খেয়াঘাটের কাছ দিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছে। দক্ষিণে প্রবাহিত ভৈরব, দড়াটানা নদী নামে পরিচিত। নদের পশ্চিম তীরে বাগেরহাট শহর ও জেলার প্রধান বাজার। এখান থেকে তীর ধরে গেলে উত্তর-দক্ষিণ দুদিকেই কয়েকটি ময়লার স্তূপ চোখে পড়ে। একদিকে অবৈধ দোকানঘর, কাঁচাবাজার, ডেকোরেটরের মালামালসহ ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন পণ্য ও আসবাব রেখে দখল করে রেখেছে পুরো তীর। অন্যদিকে বাজার থেকে মুনিগঞ্জ পর্যন্ত রয়েছে কাঠ আর ইট ও বালু ব্যবসায়ীদের দখলে। সেই সঙ্গে শহরের বিভিন্ন নালা থেকেও বর্জ্য যাচ্ছে নদে।
এ ছাড়া বধ্যভূমি, মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স, হোটেল-রেস্টুরেন্ট তৈরি করা হয়েছে নদের জায়গা দখল করে। আবার পৌর পার্ক নির্মিত হয়েছে প্লাবনভূমি দখল করে। নদের পাশ ভরাট করে গড়ে উঠেছে মোটরসাইকেল ও অটোস্ট্যান্ড।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভা, উন্নয়ন সমন্বয় সভাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভায় ভৈরবের দখল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সচেতন মহল। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভৈরব নদকে দখলমুক্ত করতে বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। তবে প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়া ও প্রশাসনের সামনেই দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয় নদে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ভৈরব নদের উত্তর ও দক্ষিণে বড় দুটি সেতু। দুই সেতুকে সংযুক্ত করা শহর রক্ষা বাঁধের পাশের বাসিন্দারা তাদের ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদে। বাজারের ব্যবসায়ীরাও ময়লার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করেন নদকে। পৌরসভার অসংখ্য ময়লার ভাগাড় রয়েছে পাড়জুড়ে। কাঁচাবাজার, মাছের বাজার, জবাই করা পশুর বর্জ্য, নষ্ট মোবাইলের যন্ত্রাংশসহ নানা ময়লা-আবর্জনা দেখা যায় নদের তীরে। এগুলো যেন দেখার কেউ নেই বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
পৌরসভার বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, শহরের পাশেই ভৈরব নদ অবস্থিত হওয়ায় আমরা প্রায়ই এর পাড়ে হাঁটতে আসতাম। নদের পাড়ে বসার খুব সুন্দর জায়গাও আছে। কিন্তু সেগুলো এখন বেশির ভাগ দোকানির দখলে। নদের পাড়ে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগটুকু এখন আর নেই ময়লা-আবর্জনা ও দুর্গন্ধের কারণে। গণশৌচাগার বন্ধ থাকায় নদী ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে পয়োনিষ্কাশনের স্থান। এতে নদ অস্তিস্ত্ব-সংকটে পড়ছে।
উন্নয়নকর্মী নাজমা আক্তার বলেন, ভৈরব নদ দখলের উৎসব চলছে বহুদিন ধরে। নদ ছোট হতে হতে দিনে দিনে খালে পরিণত হচ্ছে। আমরা চাই অবৈধ এসব স্থাপনা ও দখলদারদের অপসারণ করে নদকে যেন তার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়।

বাজারের বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণ জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা বাজারে ব্যবসা করি খাজনা দিয়ে। আমাদের বর্জ্য ফেলার জন্য তাদেরই ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত। সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে নদে ময়লা ফেলি। ময়লা তো আর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই আমাদের।
নদের তীর দখল করে গড়ে ওঠা কাঁচা বাজারের এক বিক্রেতা বলেন, প্রতিদিন ১০ টাকা করে দিতে হয়। প্রায় অর্ধশত দোকান থেকে পৌরসভার নামে এই টাকা তোলে নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা। দোকান অবৈধ কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবৈধ হবে কেন, টাকা তো দিচ্ছি।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বাগেরহাটের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক চৌধুরী আব্দুর রব বলেন, ভৈরব নদকে ঘিরে বাগেরহাট শহরের গোড়াপত্তন হলেও তাকে হত্যার কার্যক্রম চলছেই। কখনো ময়লা ফেলে, কখনো স্থাপনা গড়ে চলছে এই কার্যক্রম। বর্ষা মৌসুমই নয়, সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধ হয়ে পড়ছে বাগেরহাট শহর। রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের অগোচরে তো কিছু হয় না। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভৈরব নদকে দখল-দূষণ থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। অন্যথায় এই নদ অস্তিত্ব হারাবে বলে জানান তিনি।
নদ-নদীকে জীবন্ত সত্ত্বা উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাটের আহ্বায়ক মো. নূর আলম শেখ বলেন, নদ-নদী রক্ষার বিষয়ে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় রয়েছে। প্রতিটি জেলায় দখলদারদের তালিকা করার নির্দেশনাও রয়েছে ওই রায়ে। ভৈরব নদ দখলদারদের তালিকা যদি না থাকে, তাহলে তালিকা প্রস্তুত করে অতিদ্রুত একে দখলমুক্ত করার দাবি জানান তিনি।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, দখল-দূষণের ফলে নদ-নদীর গভীরতা কমে যায়। ফলে নদীতে বসবাস করা জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব হারানো আশঙ্কা থাকে। নদী সরু ও গভীরতা কমে যাওয়ায় আশপাশের এলাকা বর্ষাকাল ছাড়াও জোয়ারে প্লাবিত হতে পারে। এ ছাড়া নদী দখল ও দূষণের ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকার ওপরও মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে বলে জানান তিনি।
নদী-খাল রক্ষার বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের এই অধ্যাপক বলেন, নদ-নদী-খাল রক্ষায় দেশে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ খুবই কম। সে ক্ষেত্রে নদী বাঁচাতে, দেশ বাঁচাতে দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা নদী রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, ভৈরব নদের আশপাশে যারা অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছে, তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ঈদের পর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদের স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হবে। এ ছাড়া নদে ময়লা-আবর্জনা ফেলে যারা দখল-দূষণের চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা।
এনএদ