ধারণক্ষমতা ২০ হাজার, ২ লাখ যাত্রী নিয়ে ঢাকার পথে বরিশালের ১৯ লঞ্চ

পবিত্র ঈদুল ফিতরের সরকারি ছুটির শেষ দিনে অস্বাভাবিক যাত্রীর চাপ ছিল বরিশাল নদী বন্দরে। ভায়াসহ মোট ১৯টি নৌযানে ধারণক্ষমতার ১০ গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে পন্টুন ত্যাগ করেছে লঞ্চগুলো। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বরিশাল নদী বন্দর কর্মকর্তা ও বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, রোববার সরকারি-বেসরকারি অফিস চালু হওয়ায় শনিবার দিনভর যাত্রীর চাপ বেশি ছিল। শুক্রবার বরিশাল নদী বন্দর থেকে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ লঞ্চে ঢাকা গেছে। একইভাবে চাপ সামলাতে শনিবার লঞ্চ সংখ্যা বাড়ানো হয়। এদিনও কমপক্ষে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষ ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চে যাত্রা করেন।
এই কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি লঞ্চেই কিছু অতিরিক্ত যাত্রী নিয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালত লঞ্চের ছাদ থেকে যাত্রীদেরকে নামিয়ে দিয়েছে। তারপরও যে পরিমাণ অতিরিক্ত যাত্রী ছিল তা সহনীয় পর্যায়ে।

সরেজমিনে নদী বন্দর ঘুরে ও যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে লঞ্চগুলো ঢাকার পথে ছেড়ে গেলেও পন্টুনে কমপক্ষে পাঁচ হাজার যাত্রী ছিল যারা কোনো লঞ্চে ওঠার সুযোগ পায়নি। যাত্রীরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিএর অব্যবস্থাপনায় ফিরতি পথে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা লঞ্চ সার্ভিস থাকলে এ ভোগান্তিতে পড়তে হতো না।
বিআইডব্লিউটিএ ও লঞ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বরিশাল থেকে ঢাকার পথে ছেড়ে যাওয়া শনিবারের ১৯টি নৌযানের মধ্যে ১৩টি লঞ্চ সরাসরি ঢাকা রুটের। এই ১৩টি লঞ্চের মোট ধারণক্ষমতা ১৩ হাজার ৪২৯ জন। এরমধ্যে এমভি সুরভী-৮ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৮৯০ জন, মানামী লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৯১৪ জন, সুন্দরবন-১১ লঞ্চের ধারণক্ষমতা এক হাজার ৯১ জন, পারাবত-১২ লঞ্চের ধারণক্ষমতা এক হাজার ৩৫০ জন, প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চের ধারণক্ষমতা এক হাজার ১৯ জন, সুরভী-৭ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৭৪২ জন, এ্যাডভেঞ্জার-১ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৮৬৩ জন, কীর্তনখোলা-১০ লঞ্চের ধারণক্ষমতা এক হাজার ৫৫০ জন, সুন্দরবন-১০ লঞ্চের ধারণক্ষমতা এক হাজার ৩৫০ জন, কুয়াকাটা-২ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৭০৫ জন, পারাবত-৯ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৯১০ জন, পারাবত-১০ লঞ্চের ধারণক্ষমতা ৯২৫ জন, কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের ধারণক্ষমতা এক হাজার ১২০ জন।

এছাড়া দিবাসার্ভিসে এ্যাডভেঞ্জার-৬, গ্রীনলাইন-৩ ও রাজারহাট-সি এবং ভায়া রুটে এমভি মানিক-১, সম্রাট ও রাজহংস-১০ যাত্রী নিয়ে বন্দর ত্যাগ করেছে।
বিআইডব্লিউটিএর এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯টি লঞ্চে সরকারিভাবে ২০ হাজার লোকের ধারণক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবিক দেড়-দুই লাখ লোক অর্থাৎ ১০ গুণ বেশি যাত্রী নিয়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে যাত্রা করেছে। আমাদের আসলে করার কিছুই নেই। মানুষ না যেতে পারলে তাদের ক্ষতি হবে।
লঞ্চে ধারণক্ষমতার যে তথ্য প্রদর্শন করা হয় তা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে কয়েকগুণ বেশি যাত্রী নিয়ে চলাচল করে। বাস্তবতা ও প্রদর্শিত তথ্যের গড়মিল যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা বলে মনে করেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলার সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু।
তিনি বলেন, বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে লঞ্চ মালিকরা সমঝোতা করে এসব কাজ করে থাকে। এগুলো নৌযান আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। মালিকপক্ষ লঞ্চের শ্রেণি পরিবর্তন করে ফেলেন। এগুলো সরকারের কঠোরভাবে মনিটরিং করা উচিত।
কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের যাত্রী ইসমাইল হাওলাদার দাবি করেন, সবার শেষে এ লঞ্চ ঘাট ত্যাগ করেছে। লঞ্চটিতে কমপক্ষে ৬ থেকে ৭ হাজার যাত্রী রয়েছে। লঞ্চের ফ্যান্টারেও যাত্রী নিয়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় সম্পূর্ণরূপে বিআইডব্লিউটিএর।
তিনি বলেন, অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে ঢাকা যাচ্ছে। অথচ প্রশাসন কোনো কাজই করছে না। তারা লঞ্চ মালিকদের সঙ্গে ঐক্য করে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি লোক নিয়ে ঘাট ত্যাগ করাচ্ছে।

সুন্দরবন-১০ লঞ্চের যাত্রী সেলিম মাতুব্বর বলেন, সাইনবোর্ডে ধারণক্ষমতা এক হাজার ৯১ জন দেখালেও আজকে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষ নিয়ে যাত্রা করেছে। আমি নিজেও আতঙ্কে আছি, কোনো কিছু হলে কী করব। কিন্তু রোববার অফিস খুলবে এজন্য বাধ্য হয়ে যাচ্ছি।
কুয়াকাটা-২ লঞ্চের যাত্রী সেতারা বেগম বলেন, সিঁড়ির নিচে বিছানা পেতেছি। জানি না বাঁচব নাকি মারা যাব। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে উঠেছি। কাল অফিসে না গেলে চাকরি থাকবে না। তবে ভালো হতো আজ যদি সারাদিনে ডাবল ট্রিপ দিত লঞ্চগুলো। তাহলে এত দুর্ভোগে আমাদের পড়তে হতো না।
বরিশাল কোতয়ালী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) লোকমান হোসেন বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তায় ২৬ রমজান থেকেই পুলিশ স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছে। সার্বক্ষণিক টহল ব্যবস্থা করা হয়েছে নদী বন্দরে। শনিবার যাত্রীর চাপ বেশি। তবে সবার নিরাপত্তায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।

এমভি সুন্দরবন নেভিগেশনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, গতকালের তুলনায় আজকে (শনিবার) যাত্রীর চাপ কিছুটা বেশি। ছোট লঞ্চের তুলনায় বড় লঞ্চের দিকে যাত্রীদের আকর্ষণ বেশি থাকায় যাত্রীও বেশি ওঠে এসব লঞ্চে। তবে আমরা চেষ্টা করেছি অস্বাভাবিকভাবে যেন অতিরিক্ত যাত্রী না ওঠে সেদিকে। যাত্রীদের নিরাপদে পৌঁছে দিতে আমরা সর্বাত্মক কাজ করেছি।
বরিশাল সদর নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাসনাত জামান বলেন, রোববার সব অফিস খুলে যাওয়ায় শনিবার অস্বাভাবিক যাত্রী চাপ ছিল। নৌ-পুলিশ যাত্রীদের নিরাপত্তায় কাজ করছে। যারা পন্টুনে থেকে গেছেন তাদের যেন কোনো ধরনের সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/ওএফ