মহাসড়কে শুকানো হচ্ছে ধান-খড়, দুর্ঘটনার আশঙ্কা

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে নিয়ম লঙ্ঘন করে চলছে ধানমাড়াই। এরপর সড়কের ওপরেই শুকানো হচ্ছে ধান ও খড়। এতে নির্মাণাধীন ছয় লেনের সড়কটি কোথাও সংকুচিত, আবার কোথাও প্রসারিত হয়ে পড়েছে।
এ চিত্র পায়রাবন্দ বৈরাগীগঞ্জ থেকে জায়গীরহাট ও মিঠাপুকুরের কিছু অংশ হয়ে পীরগঞ্জের বড় দরগাহ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশ পর্যন্ত। পুরো সড়কের প্রায় ১৮ থেকে ২০ কিলোমিটার অংশ এখন ধান শুকানোর চাতালে পরিণত হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পথচারী ও যানবাহনের চালকরা। যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সচেতন ব্যক্তিরা।
তবে হাইওয়ের দায়িত্বে পুলিশ সদস্যরা বলছেন, শুধু মহাসড়ক নয়, আঞ্চলিক ও গ্রামীণ সব সড়কেই এ সময় কৃষকরা ধান শুকানোর জন্য ঝুঁকি নেন। তাদের বাধা দিয়েও কাজ হচ্ছে না।
শুধু রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে নয়, উপজেলার গড়েরমাথা নামক স্থান থেকে ফুলবাড়ী এশিয়ান হাইওয়ে সড়কেও দেখা গেছে এমন চিত্র। এ ছাড়া রংপুর সদর, পীরগাছা, কাউনিয়া, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, পীরগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলার প্রায় প্রতিটি সড়কে। ধান কাটার এই মৌসুমে গ্রামের পাকা রাস্তাগুলোতেও একই হাল।
সরেজমিনে মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ বৈরাগীগঞ্জ থেকে জায়গীরহাট পর্যন্ত যেতে মহাসড়কের দুই পাশের ধান ও খড় শুকানোর হিড়িক দেখা গেছে। কৃষাণ-কৃষাণী থেকে শুরু করে ছোট ছেলে-মেয়েরা সবাই ব্যস্ত ধান শুকানোর কাজে। গেল কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাত হওয়ায় মহাসড়কের কোলঘেঁষা গ্রামের কৃষকরা এখন তাদের ভেজা ধান ও খড় শুকানোর জন্য সড়কের বিভিন্ন স্থান দখলে রেখেছে।
একই চিত্র মিঠাপুকুর সদরের কিছু অংশ হয়ে পীরগঞ্জের বড় দরগাহ যেতেও দেখা যায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাষিরা যেমন সড়কে ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত, তেমনি বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত চালকরা। অনেকে আবার সড়কের দুপাশে যত্রতত্র ধান ও খড় শুকানোয় গাড়ি চালাতে পারছেন না। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়।
ওই সড়ক ধরে ঢাকা থেকে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীর দিকে যাচ্ছিল অপরুপা পরিবহন। এই পরিবহনের সহকারী মিজান মিয়া বলেন, এখন মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে ধান ও খড় শুকানো হচ্ছে। এ কারণে নির্দিষ্ট গতিতে গাড়ি চালানো যাচ্ছে না। ভেজা ধান ও খড়ের ওপর দিয়ে বাস চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো সময় দুর্ঘটনাও ঘটতে পারে।
রবিউল ইসলাম নামের এক ট্রাকচালক বলেন, মহাসড়কের নির্মাণকাজ চলমান থাকায় গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে গাড়ি চালানো হচ্ছে। এরপর যদি সড়কের কোথাও কোথাও ধান ও খড়ের স্তূপ থাকে, তাহলে তো আমাদের সমস্যা। হর্ন দিলেও শোনে না, হুট করে রাস্তা পারাপার হয়। অনেকে তো মহাসড়ককে ধান শুকানোর চাতালের মতো করে ব্যবহার করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন।

জায়গীরহাট বাসস্ট্যান্ডের সামনে কথা হলে ভ্যানচালক মোতালেব মিয়া বলেন, রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের ছয় লেনের কাজ শুরুর পর থেকে যানবাহন চলাচল একটু ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। তার ওপর মাসখানেক ধরে সড়কটির ৭-৮ কিলোমিটার অংশ বিভিন্ন স্থানে ধানমাড়াই, খড় ও ধান শুকানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। সড়কে ধান শুকানো বন্ধে প্রশাসন কিছু করছে না। এ জন্য ঝুঁকি নিয়ে আমরা চলাচল করছি।
পায়রাবন্দ চূহড় উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে একটি হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে পানি দিচ্ছিলেন শামীম পারভেজ নামে এক চাকরিজীবী। তিনি পীরগঞ্জের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তিনি বলেন, আমি প্রতিদিন বাইক চালিয়ে পীরগঞ্জে যাই। কিন্তু সড়কে ধান শুকানোর কারণে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। খড় ও ধুলাবালু চোখে পড়ায় যাত্রাবিরতি করে পানি দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে নিলাম।
মহাসড়ক ধরে পীরগঞ্জ যাওয়ার পথে বলদিপুকুর, জায়গীরহাম শঠিবাড়ী ও বড়দরগাহ এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রংপুর-ঢাকা মহাসড়কটি একটি ব্যস্ততম সড়ক। ওই সড়ক দিয়ে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, রংপুর জেলার মানুষ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেন। তবে প্রতিবছর ধান কাটা-মাড়াইয়ের মৌসুমে সড়কটির বিভিন্ন অংশে ধানমাড়াই, খড় ও ধান শুকানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ কারণে কখনো কখনো ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটছে।
বলদিপুকুরে রংপুর ডেইরী ফুড অ্যান্ড প্রোডাক্টস লিমিটেডের কারখানার সামনে বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষকে ধান শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায়। তাদের একজন শালাইপুর গ্রামের নুপুর বেগম। স্বামী ও দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মহাসড়কে ভেজা ধান নেড়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
এই প্রতিবেদককে নুপুর বেগম বলেন, কয়দিন ধরি ঝড়বৃষ্টি হওছে। ধান নিয়্যা খুব যন্ত্রণাত আছি বাহে। বাড়িত হামার ধান শুকাবার জাগা নাই। ওই তকনে বাড়ির গোড়ের রাস্তাত আলছি।
সড়কপথে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা বাড়লেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে সড়কের ওপর ধান, খড় ও ভুট্টা শুকানোর কাজ বন্ধ করা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান বাড়লেও মৃত্যুরোধে সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল ও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সেল কোনো ভূমিকা রাখছেন না বলে মনে করছেন বিভিন্ন সংগঠক ও সচেতন ব্যক্তিরা।
নিরাপদ সড়ক চাই রংপুরের সাংগঠনিক সম্পাদক মুরাদ মাহমুদ বলেন, সড়কের দুই পাশে ধান, খড়, ভুট্টাসহ অন্যান্য অনেক ফসল শুকানো হয়। এতে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। কখনো কখনো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হচ্ছে মহাসড়কে ধান-খড় শুকানো। এসব বন্ধে আদালতের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু সে নির্দেশনা পালন ও প্রয়োগ করার মতো কারও উদ্যোগ নেই।
বড় দরগাহ হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহজাহান আলী জানান, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাসড়কে ধান শুকানো ঠিক নয়। এ কারণে সড়কে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। আমরা দুই দিন মাইকিং করেছি। মানুষকে সচেতন করার চেষ্টাও করছি। কিন্তু বাধা দিয়েও কাজ হচ্ছে না। এসব বন্ধে আরো কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এনএ