কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র চাষিরা

কাঁচা চা পাতার ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না পঞ্চগড়ের ক্ষুদ্র চা চাষিরা। ন্যায্যমূল্যের দাবিতে বার বার মানববন্ধন-সমাবেশ করেও কোনো লাভ হয়নি। আন্দোলনের মুখে গত ১৮ মে সন্ধ্যায় জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে মূল্য নির্ধারণ কমিটির জরুরি সভায় কাঁচা চা পাতার দাম ১৮ টাকা কেজি নির্ধারণ করার পরও নির্ধারিত মূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। নির্ধারিত মূল্যে কাঁচা চা পাতা কিনছেন না কারখানা মালিকরা। ফলে নতুন চাষি ও বাগান মালিকরা চা চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়। শুরুতে বড় আকারের বাগান গড়ে না উঠলেও দ্রুত তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ার কারণে কৃষকরা অন্যান্য ফসলের আবাদ ছেড়ে চা আবাদ শুরু করেন। শুরু হয় বাংলাদেশে প্রথম ক্ষুদ্র চাষিদের চা চাষ । সরকারও ক্ষুদ্র চা চাষিদের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। গড়ে ওঠে চা কারখানা। বর্তমানে জেলায় ২২টি চা কারখানা রয়েছে।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ড কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গে ক্ষুদ্র চা চাষে নারীদের দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে। ২০২১ সালে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় ৮ হাজার ৩১০টি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানে মোট ১১ হাজার ৪৩৪ হাজার একর জমিতে চা চাষ হয়েছে। এসব চা বাগানের মালিকের মধ্যে অনেকেই নারী। এসব চা বাগান থেকে ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। উত্তরবঙ্গের চা বাগান থেকে ২০২২ সালে ১ কোটি ৮০ লাখ কেজি চা পাতা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
বর্তমানে বাড়ির আনাচে-কানাচে গড়ে উঠছে চা বাগান। করোনাকালে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি চা উৎপাদন হয় এই জেলায়। শুধু এই জেলায় নয়, ক্রমেই উত্তরের আরও বেশ কয়েকটি জেলার সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়েছে। চাষিরা শুরুর দিকে কাঁচা চা পাতার মূল্য ভালো পেলেও গত কয়েক বছর ধরে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না।
চাষিদের অভিযোগ- এক সময় কাঁচা চা পাতা কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বিক্রি হলেও বর্তমানে ৭ থেকে ৯ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বর্তমানে তারা খরচও তুলতে পারছেন না।
চাষিরা জানান, কারখানাগুলোতে ১ কেজি চা পাতা দিলে ২৫ শতাংশের দাম দেয় না। ১২ থেকে ১৫ টাকা মূল্য দিলেও ওই ২৫ শতাংশের দাম দেওয়া হয় না। কারখানা মালিকরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেট করে কাঁচা চা পাতার মূল্য কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে ৪ কেজি কাঁচা চা পাতা দিয়ে তারা ১ কেজি চা পাতা তৈরি করেন। অকশন মার্কেটে ১ কেজি চা পাতা বিক্রি হয় ১৬০ থেকে ২০০ টাকায়। কারখানা কর্তৃপক্ষ ভালোমানের চা পাতা অকশনে না পাঠিয়ে রাতের অন্ধকারে অবৈধভাবে স্থানীয় চা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেয়। এতে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। ফলে অকশন মার্কেটে পঞ্চগড়ের চায়ের দাম ভালো পাওয়া যায় না। আর এর প্রভাব পড়ছে চা চাষিদের ওপর।
চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চাষিদের ১ কেজি কাঁচা চা পাতা উৎপাদন করতে ১৫ থেকে ১৬ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু বিক্রয় মূল্য মাত্র ৭ থেকে ৮ টাকা।
সদর উপজেলার চা চাষি মো. শাহজালাল জানান, প্রত্যেক কারখানা রাতের অন্ধকারে অবৈধভাবে স্থানীয় বাজারে তৈরি চা পাতা বিক্রি করছে। অবৈধভাবে কয়েকশ চা কোম্পানি চায়ের ব্যবসা করছে। প্রত্যেক কারখানা একটি করে দালালের দল সৃষ্টি করেছে। দালাল ছাড়া তারা কৃষকের কাছ থেকে চা পাতা কিনছেন না। তারা হঠাৎ চা পাতার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। চা পাতার দাম কমে যাওয়ায় চা চাষিরা পথে বসে গেছেন। এভাবে চলতে থাকলে চা চাষিরা বাগান কেটে ফেলবেন।
আরেক চা চাষি মিজানুর রহমান বলেন, প্রভাবশালী চা বাগান মালিকরা কাঁচা চা পাতা সঠিক মূল্যে কিনলেও আমরা যারা ক্ষুদ্র চা চাষি রয়েছি তাদেরকে সঠিক দাম দেওয়া হচ্ছে না। চা বাগান এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ ব্যাপারে নর্থবেঙ্গল চা কারখানার সুপারভাইজার মোস্তাফিজুর রহমান বাচ্চু বলেন, স্থানীয় বাজারে আমাদের চা কারখানা থেকে চা বিক্রি হয় না । আমরা ২৫ শতাংশ নয়, ১০ শতাংশ কাঁচা চা পাতা কেটে নেই। যার মূল্য আমরা দেই না। কারণ অনেক সময় চা চাষিরা বড় পাতা দেন। এতে চায়ের মান খারাপ হয়। বর্তমানে অকশনে পঞ্চগড়ের চায়ের মূল্য ১২০ টাকা কেজি।
বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও নর্দার্ন বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, চা পাতার মূল্য নির্ধারণ কমিটি কাঁচা চা পাতার মূল্য কেজি প্রতি ১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু কারখানাগুলো এখনো তা মানছে না। এ ব্যাপারে অচিরেই জেলা প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ নেবে।
আরএআর