স্যান্ডেল পোড়ানোর ধোঁয়া ধুলাবালু ও শব্দদূষণের মধ্যে চলছে ক্লাস

স্কুল ভবনের পাশে পুরোনো ও পরিত্যক্ত স্যান্ডেল পোড়ানো হচ্ছে। ফলে কালো ধোঁয়া উড়ে গিয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢুকছে। পাশাপাশি মেশিনে পিচ ও পাথর ভাঙা হচ্ছে। অতিরিক্ত ধুলাবালু ও শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এতে কোমলমতি শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতিসহ শারীরিকভাবে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে তারা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই এ ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।
উজিরপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ উজিরপুর নাসির মন্ডলের টোলা গ্রামে এই স্কুলের অবস্থান। পিচ গলানোর সঙ্গে পাথর ও পিচের মিশ্রণ করানোর মেশিনের শব্দে শিক্ষকের পাঠদান বুঝতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, পদ্মা নদী রক্ষা বাঁধের সড়কে চলছে পিচ কার্পেটিংয়ের কাজ। সংস্কারকাজের জন্য বিদ্যালয়ের পেছনেই এসব কাজ করা হচ্ছে। সাত দিন ধরে পিচ গলাতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে পুরোনো স্যান্ডেল। এতে কালো ধোঁয়ায় ক্লাসে বসা শিক্ষার্থীরা দূষণের শিকার হচ্ছে। মেশিনের শব্দে ও ধুলাবালুতে অতিষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
সেখানে কথা হয় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। তারা জানায়, কালো ধোঁয়ায় তাদের চোখ জ্বালা করে। দম বন্ধ হয়ে আসে। বমি বমি ভাব হয়। টিনের অস্থায়ী শ্রেণিকক্ষ হওয়ায় কালো ধোঁয়া বা শব্দ কোনোটাই আটকানো যায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক সহকারী শিক্ষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এখন নিয়মিত ক্লাস চলছে। এর মধ্যে কালো ধোঁয়া যখন ঢুকছে, তখন লেখা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা হাত দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরছে।

সহকারী শিক্ষক সেলি খাতুন ও মমতাজ খাতুন জানান, গত সাত থেকে আট দিন ধরে হঠাৎ স্কুলের গা ঘেঁষে পিচ গলাতে স্যান্ডেল পোড়ানো ও পিচ-পাথর মেশানো শুরু হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে উৎকট গন্ধ আসে। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের খুব কষ্ট হয়। এরই মাঝে বাধ্য হয়েই ক্লাস করতে হচ্ছে।
চতুর্থ শ্রেণির শামীম, পঞ্চম শ্রেণির মরিয়ম, সিমা খাতুন বলে, ক্লাস করার সময় মেশিনের ধুলাবালু চোখেমুখে আসে। কালো ধোঁয়া নাকের কাছে আসলে বমি বমি ভাব হয়। ম্যাডামদের বারবার বলেও কোনো লাভ হয় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিয়োজিত এক শ্রমিক জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার ছত্রাজিতপুর থেকে এসব রাবারের পুরাতন ও পরিত্যক্ত স্যান্ডেল কিনে এনে পোড়ানো হয়। কেজিপ্রতি ১১ টাকা করে এসব স্যান্ডেল কেনা হয়েছে। বেশি সময় ধরে জ্বলে বলে মালিকরা এসব পোড়াচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্যান্ডেল পোড়ানোর ধোঁয়ায় ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার আমের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এই এলাকার প্রধান অর্থকরী ফল আম। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমচাষিরা। যে আমে ধোঁয়া লাগে, সেসব আম স্বাভাবিক মিষ্টতা ও আমের গায়ের রং নষ্ট হয়। এতে আমের দাম পাওয়া যায় না।
স্থানীয় বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এর আগে দেখেছি পিচ গলাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ও জুট ব্যবহার করত। কিন্তু স্কুল ও আবাসিক এলাকায় এভাবে রাবারের স্যান্ডেল ব্যবহার করতে প্রথম দেখছি। মানুষের স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি বিবেচনায় প্রশাসনকে স্যান্ডেল পোড়ানো বন্ধ করার অনুরোধ করছি।
দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিচ গলানো ও মেশিনে পাথর মিশ্রণের কাজ শুরুর কয়েক দিন আগে ঠিকাদারের লোকজন এসেছিল আমার কাছে। তারা আমাদের স্কুলের পাশের জায়গায় কাজ করবে, এর বিনিময়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার জন্য একটি দোলনা কেনা বাবদ ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই আর কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি।

এ বিষয়ে ঠিকাদার খাইরুল কবির রানা মুঠোফোনে জানান, উন্নয়নকাজ করতে গেলে একটু অসুবিধা হবেই। তাই এই সাময়িক অসুবিধার বিষয়টি মেনে নিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। তবে জ্বালানি হিসেবে পুরাতন রাবারের স্যান্ডেল পোড়ানোর পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর জানেন কি না, এ প্রশ্নে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোজাহার আলী প্রাং ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে এসব কাজ করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া পিচ গলাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ বা কাপড়ের জুট ছাড়া স্যান্ডেল ব্যবহার করার কোনো নিয়ম নেই।
উল্লেখ্য, দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীসংখ্যা ১২০ জন এবং শিক্ষক রয়েছেন ৪ জন।
মো. জাহাঙ্গীর আলম/এনএ