আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে লজ্জা করা যাবে না

ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছর পেরিয়ে গেছে। তবু স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সার্বজনীন প্রচলন নেই। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ভিনদেশি ভাষার প্রতি দরদে বিকৃত বাংলায় কথা বলার ব্যবহার বেড়েছে। মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়ায় হারাতে বসছে মায়ের মুখে প্রথম বুলিতে শেখা আঞ্চলিক ভাষাও।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে শুদ্ধ বাংলা চর্চার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষাকে আঁকড়ে ধরে সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিতের আহ্বান রংপুরের ভাষাসংগ্রামীদের।
ঢাকা পোস্টের সঙ্গে ভাষাসংগ্রামের প্রেক্ষাপট, অর্জন এবং বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে আলাপচারিতায় ৬৯ বছর আগের স্মৃতিকথা তুলে ধরেন ভাষাযোদ্ধা প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল ও আশরাফ হোসেন বড়দা। জীবনের পড়ন্ত বেলায় তাদের চাওয়া নতুন প্রজন্মের হাত ধরে বাংলা ভাষার সর্বত্র ব্যবহার নিশ্চিত হোক।
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে। ভাষাসংগ্রামে পিছিয়ে ছিল না রংপুর। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত রংপুরের ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ধারাবাহিকভাবে মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন করেছেন। ভাষাসংগ্রামে রংপুরের যেসব ভাষাযোদ্ধা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন বর্তমানে তাদের তিন-চারজন বেঁচে আছেন। প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল, আশরাফ হোসেন বড়দা এবং মীর আনিসুল হক পেয়ারা তাদের মধ্যে অন্যতম।
ঢাকা পোস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম সংগ্রাম বলে উল্লেখ করেছেন এই ভাষাসংগ্রামীরা। একই সঙ্গে তারা বলেছেন, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা।
রংপুর জিলা স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন মোহাম্মদ আফজাল। বয়সে ছোট হলেও প্রতিটি মিটিং মিছিলে তার ছিল উচ্চকণ্ঠ। বড়দের ভিড়ে সাহসের তকমা ছড়িয়েছেন। তিনি ছিলেন সাবেক পৌর চেয়ারম্যান, গণতন্ত্রী পার্টির উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি।
সংগ্রামী, নির্লোভ এই কিংবদন্তি রাজনীতির কারণে সংসারি হননি। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে জীবনের দীর্ঘ সময় কারাগারে ছিলেন। তিনি এখন নিজ বাড়িতে একা থাকেন। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙে পড়েছে। ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। চোখেও কম দেখেন। কখনো কখনো কানে ঠিকমতো শুনতে পান না।
নগরীর মুন্সিপাড়ার বাড়িতে কথা হয় ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আফজালের সঙ্গে। বাড়ির এক অংশে ছাত্রদের জন্য মেস করেছেন। স্ত্রী-সন্তান না থাকায় কয়েকজন নিকটাত্মীয় তার দেখাশোনা করেন।
মোহাম্মদ আফজাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টি থেকে বৈষম্য ছিল। সেই বৈষম্য, নিপীড়ন, নির্যাতন এবং বাঙালিদের অধিকারবঞ্চিত রাখার প্রবণতা থেকেই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মানতে নারাজ ছিল। এ কারণে ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। যা চূড়ান্ত দানা বাঁধে ১৯৫২ সালে। পাকিস্তানের বেশির মানুষ ছিল পূর্ব বাংলার। আমাদের ৫৬ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ জন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হয়ে বসেছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। মুসলিম লীগের প্রধান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ অন্যান্য নেতারা ক্ষমতায় বসে প্রথম থেকেই পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকেন। তারা পূর্ব বাংলাকে সবদিক দিয়ে বঞ্চনা শুরু করেন। এর মধ্যে বাংলা ভাষাকে তারা টার্গেট করে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেন। যা আমরা মেনে নিইনি।
তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ইতিহাস সবার জানা। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর হাতে রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম ও বরকতসহ অনেকেই শহীদ হন। এ ঘটনার পর ভাষা আন্দোলন ঢাকাসহ সারাদেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন ছাত্র। জিলা স্কুলে পড়তাম। কারমাইকেল কলেজের ছাত্রদের নেতৃত্বে আমরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। অনেক ত্যাগ, সংগ্রাম আর কষ্টের ফসল বাংলা ভাষা।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করেছিল। ভাষা আন্দোলন সফল না হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা পেতাম না। এখন দেশ স্বাধীন। দেখতে দেখতে ৫০ বছর হতে যাচ্ছে। দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু বৈষম্যমূলক, অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপূর্ণতা আসেনি। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। এখনো ইংরেজিতে বিচার বিভাগে রায় লেখা হয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড ব্যবহার হয়। ৭০ বছর পরও এসব দেখা আমাদের জন্য কষ্টের।
মোহাম্মদ আফজাল, ভাষাসৈনিক
নগরীর গুপ্তপাড়ার নিউক্রস রোডে ডুয়ার্স ভবনে থাকেন ভাষাসৈনিক আশরাফ হোসেন। রংপুরের মানুষের কাছে তিনি ‘বড়দা’ নামে পরিচিত। তার জীবনে রাষ্ট্রভাষার সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ার গল্পটা একটু ভিন্ন। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর একটি প্রবন্ধ পড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রতি উদ্বুদ্ধ হন তিনি। প্রগতিশীল শিক্ষক স্যার সন্তোষ গুহ ও কবি শাহ আমানত আলীর কাছে পেয়েছিলেন প্রাণের ভাষা বাংলার জন্য অনুপ্রেরণা।
আশরাফ হোসেন বড়দা ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৯৫২ সালে তিনি লালমনিরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তখন থেকে লালমনিরহাটের আবুল হোসেন, শামছুল হক, আনিছুল হক, ষষ্ঠী সরকার, নাসির উদ্দিন, নাসিম আহমেদ ও টুক চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গে মিছিলে যেতেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গের খবর শুনে রংপুরের রাজপথে নামেন তিনি। সেসময় তিনি ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। পরবর্তীতে ভাষাসংগ্রাম তুঙ্গে উঠলে প্রতিদিন মিটিং মিছিলে অংশ নেন।
এই ভাষাসৈনিক বলেন, ভাষা সংগ্রাম না হলে হয়তো আজকের বাংলাদেশ হতো না। ভাষা আন্দোলনই ছিল বাঙালির সাহসিকতার প্রমাণ। ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগ পরবর্তীতে ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচনে জয়; এগুলো মুক্তিযুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। ভাষা আন্দোলনই বাংলাদেশের মূল শেকড়।
শুদ্ধ বাংলা চর্চা, সর্বত্র বাংলার ব্যবহার এবং আঞ্চলিক ভাষা টিকে রাখার নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার পরামর্শ দিয়ে আশরাফ হোসেন বড়দা বলেন, আঞ্চলিক ভাষা তো মায়ের ভাষা, নিজের গ্রামের ভাষা। এটা নিজের প্রথম বুলি। আঞ্চলিকতা মানে সংকীর্ণতা নয়। এই ভাষার মাঝেই আত্মপরিচয় আছে। মায়ের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা করা যাবে না। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
আশরাফ হোসেন বড়দা, ভাষাসৈনিক
আন্দোলনের কারণে ১৯৫৪ সালে আত্মগোপনে চলে যান আশরাফ হোসেন। ১৯৫৫ সাল থেকে রংপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কমেছে স্মৃতিশক্তি। তবে ৬৯ বছর আগের ভাষা সংগ্রামের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করতে ভুল হয় না তার।
প্রসঙ্গত, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উর্বর ভূমি রংপুর। ভাষা আন্দোলনে এই জেলার অনেক মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। তাদের মধ্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন লে. কর্নেল জাহিদুল হক চৌধুরী, শামসুল হুদা (আবু), অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম, সিদ্দিক হোসেন, ডা. রোকেয়া আলমগীর রুবি, কমরেড বিনয় সেন, মজিবর রহমান মতি মিয়া, ডা. শোভান খান, ডা. দীনেশ চন্দ্র ভৌমিক (মন্টু ডাক্তার), মকবুল হোসেন, কানু ঘোষ, আফান উল্লাহ, মোসলেম আলী খান, ইব্রাহিম খান সুরুজ, ডা. কবির খান বখতিয়ারি, অ্যাডভোকেট গাজী রহমান, কামরান শাহ আবদুল আউয়াল, অধ্যাপক রেজা শাহ তৌফিকুর রহমান, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, তোজাম্মেল আলী, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী, শাহ আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ আফজাল, আশরাফ হোসেন বড়দা, শাহ তবিবর রহমান প্রধান, মীর আনিসুল হক পেয়ারা, তনসিম উদ্দিন আহমেদ মনু ও পানার উদ্দিনসহ আরও অনেকে।
ভাষা আন্দোলনে রংপুরের ছাত্র-জনতার মধ্যে সমন্বয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ভাষাসৈনিক শাহ তোফাজ্জল। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছিলেন ভাষা আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ‘কমিটি অব অ্যাকশন’ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তাকেসহ অনেককে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রংপুর।
শাহ তোফাজ্জলসহ রংপুরের সাবেক মন্ত্রী মরহুম মতিউর রহমান, অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান, ইয়াকুব আলী, মাহফুজ আলী, কাজী মুহাম্মদ এহিয়া, মণি কৃষ্ণ সেন, শংকর বসু, শাহ আবদুল বারী, ধীরেন ভট্টাচার্য, জীতেন্দ্রনাথ দত্ত, ইদ্রিস লোহানী, সুফী মোতাহার হোসেন, কছিম উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, আজমল হোসেন, আবুল হোসেন, ডা. মোজাহার উদ্দিন, ডা. আবতাব উদ্দীন তালুকদার, ভিখু চৌধুরী, শাহ আবদুল বারী, অ্যাডভোকেট নুরুল হক, দবির উদ্দিন আহম্মদ, খয়রাত হোসেন, নাজিম খন্দকার, মোহাম্মদ আফজাল, আজিজার রহমান, নাজমুল আলম চৌধুরী হেবিন, মতিয়ার রহমান, আজিজুল হক সেলিম, আবদুস সোবহান, কৃষক নেতা দরাজ আলী ও শাহ তবিবর রহমান প্রধান তখন ভাষা আন্দোলনে পুরোধা হিসেবে কাজ করেছেন।
এএম