এখনো মিলিত হন, আড্ডা-গল্পে মেতে ওঠেন তারা

দুই বন্ধু বয়সে ছয় মাসের ছোট-বড়। একই গ্রামে বেড়ে ওঠা, প্রাইমারি থেকে হাইস্কুলেও পড়েছেন একসঙ্গে। তারপর দুই বন্ধুর পথ জীবন-জীবিকার তাগিদে চলে গেছে দুদিকে। দুজন অবসর কাটান পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু আগের মতোই সকালে বাড়ি থেকে বের হয়ে বসে পড়েন গল্প-আড্ডায়। মেতে ওঠেন স্মৃতিচারণায়।
সেই বাল্যকাল-কৈশোর-তারুণ্য পেরিয়ে দুই বন্ধু খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু ও মিজানুর রহমান আজ ষাটোর্ধ্ব। ফখরুল আনাম দীর্ঘদিন ঢাকায় খন্দকার আব্দুল করিম মিঞা বিএম কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। মিজানুর রহমান চাকরি করতেন পানি উন্নয়ন বোর্ডে। জীবনের পড়ন্তবেলায় তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আগের মতোই প্রখর।
রোববার (৭ আগস্ট) আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস। এদিন সকালে দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয় রংপুর নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ে। সেখানে একটি বিপণিবিতানে বসে গল্প করছিলেন তারা। আড্ডার সেই ফাঁকে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদক তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বন্ধু, বন্ধুত্ব আর বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে আলোচনায় উঠে আসে তাদের শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের গল্প।
অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, আমার কাছে বন্ধুর কোনো সীমারেখা নেই। বন্ধু হচ্ছে মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়ানো বিহঙ্গের মতো। বন্ধুর বিচরণ হবে বাধাহীন। বন্ধুত্বের কোনো বয়স থাকে না। আমার ৬৫ বছরের এ জীবনে বন্ধুত্বের কোনো ঘাটতি রাখিনি। মাঝখানে আমি ঢাকায় ছিলাম, আমার বন্ধু মজনু সরকারি চাকরিতে ছিল। কিন্তু আমাদের যোগাযোগটা থাকত মনের টেলিফোনে। আমাদের বন্ধুত্বে ভালো লাগা, ভালোবাসা, বিশ্বাস, সৌহার্দ, সম্প্রীতি অটুট রয়েছে আগের মতোই।

আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, হঠাৎ চিৎকার করে বলা ‘বন্ধু, কী খবর বল’— এই শব্দটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। এখনকার বন্ধুত্ব ডিভাইস-নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। বন্ধুত্ব চলে গেছে ফেসবুকে। এ বন্ধুত্ব হৃদয় থেকে হৃদয় স্পর্শ করছে না। এখনকার ‘ছেলে-মেয়েরা হায় কেমন আছ’ বা ‘হ্যালো’ বলছে। কিন্তু কিরে দোস্ত, কেমন আছিস, এই দোস্ত কথাটা এখন কেউ আর বলতে চায় না। আজকালকার আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাওয়া সেই আগেরকার দিনের বন্ধুত্ব ফিরে আসুক।
আমরা আমাদের বড় ভাই-বোনদের মধ্যে নস্টালজিক বিষয় ও ভালোবাসা দেখেছি। এখনকার ছেলে-মেয়েদের কাছে আমাদের সেই বন্ধুত্বের কথাগুলো শেয়ার করতে হবে। নয়তো একসময় আসবে বন্ধু হারিয়ে যাবে। আর বন্ধু কিংবা বন্ধুত্ব যদি হারিয়ে যায়, তাহলে সমাজে বিভক্তি বাড়ার সঙ্গে নীতিনৈতিকতা বিবর্জিত মানুষ তৈরি হবে, যোগ করেন তিনি।
পীরগাছার অন্নদানগর উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়কার স্মৃতিচারণা করে ফখরুল আনাম বলেন, একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন আমি লুঙ্গি পরে স্কুলে গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে আমাদের ক্লাসের সামনে মাঠে পানি জমে গিয়েছিল। সবাই মাঠে দৌড়াদৌড়ি করছে। একপর্যায়ে কে কাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে নামাতে পারে, শুরু হলো সেই চেষ্টা। তখন আমি আর মনজু ধাক্কা দেওয়া ও কাদার মধ্যে জড়াজড়ি করেছিলাম। সবাই আমাদের দেখে হাততালি দিয়ে হই-হই করছিল। সেই কাদামাখা শরীরে কলাপাতা বা কচুপাতা মাথায় দিয়ে বইগুলো বুকে চেপে ধরে স্কুল থেকে ফিরে আসা। আবার একসঙ্গে মাছ ধরা, ডাব চুরি করা, খেলাধুলা করা, এসব নস্টালজিক স্মৃতি এখনো ধরা দেয় মনে।
বন্ধুত্বে গরিব-ধনীর ব্যাকরণ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বন্ধুত্ব হয় মনের সঙ্গে মনের মিলে। পারিপার্শ্বিক অবস্থায় বা সমাজের চোখে অর্থবিত্তে বন্ধুত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করা যায় না। এ কারণে এখনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে বুকে জড়িয়ে ধরে ‘দোস্ত’, ‘তুই-তুকারি’ করেন এই মানবাধিকার কর্মী।
ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, আমার বন্ধুদের অনেকে স্কুলের গণ্ডি পার হতে পারেনি। কিন্তু তাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শেষ হয়নি। এখনো গ্রামে গেলে অনেক বন্ধুকে দেখি চাষাবাদ করতে, কাউকে হাটবাজারে দোকানদারি করতে। কিন্তু যখন এদের সঙ্গে দেখা হয়, তখন আমরা দোস্ত বলে বুকে জড়িয়ে ধরে সেই শৈশবে ফিরে যাই।
আমার এক বন্ধুর বাবা নরসুন্দর ছিলেন। এ কারণে ওই বন্ধু আমার থেকে সব সময় দূরে থাকার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি তাকে দূরে থাকতে দিইনি। এখনো গ্রামের গেলে আমরা একসঙ্গে বসে গল্প করি। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যারা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন আয়ের, তাদের সহযোগিতা করি। আমার কাছে এই স্বার্থহীন ভালো লাগা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতাটাই বন্ধুত্ব।

বন্ধু মিজানুর রহমান মজনু বলেন, রক্তের বাঁধন, ভাই-বোন বা নিকটতম যারা আছে, সবার ঊর্ধ্বে বন্ধু। রক্তের বন্ধনের চেয়েও বড় বন্ধন বন্ধুত্বে। জীবনের পড়ন্তবেলায় বন্ধুত্বের বন্ধনটা খুব বেশি উপলব্ধি হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের শ্রেণিবিন্যাস মনে খুব নাড়া দেয়। যখন শৈশবে ছিলাম, তখনকার বন্ধুত্বের স্মৃতি বেশি আবেগতাড়িত করে। আগে সমবয়সী ভাই-বোন, মামা-চাচা, গ্রামবাসী সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠত কিন্তু এখন সেটা নেই। স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্রেও বন্ধু থাকে কিন্তু কখনোই শৈশবের বন্ধুত্বের মতো হয় না।
তিনি বলেন, জীবনে ব্যস্ততা, যন্ত্রণা, যাতনা থাকবে। কিন্তু বন্ধুত্বের বেলায় শত ব্যস্ততার মাঝেও যোগাযোগ, দেখা-সাক্ষাৎ, আড্ডাটা খুবই গুরুত্ব বহন করে। আমি চাকরিজীবনেও সব সময় চেষ্টা করেছি বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার। দেশ-বিদেশে থাকা বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ হতো। এখনো শহর থেকে গ্রামে গেলে আমরা বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে আড্ডা-গল্পে শৈশবের স্মৃতিতে ফিরে যাই। কিন্তু বর্তমান সমাজে আমাদের সময়কার মতো বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনটা কেন জানি চোখে পড়ে না। আগের মতো এখন বন্ধুদের মধ্যে আন্তরিকতা, পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক শিক্ষার চর্চাটা নেই। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে বন্ধুত্বের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। অথচ বন্ধু বন্ধুই। এর কোনো বয়স, রং, ধর্ম, ধরণ, শ্রেণিভেদ নেই।
আধুনিক ও অপসংস্কৃতির গ্রাসে এখনকার বন্ধুত্বের স্থায়িত্ব কম দাবি করে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী মজনু বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়েরাসহ বর্তমান প্রজন্ম একটা ফ্রেমের মধ্যে আটকা পড়েছে। তারা এখন যে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠছে, তাতে প্রকৃত বন্ধুত্বের শিক্ষা নেই। এখন নেশার সঙ্গে বন্ধুত্ব, ফেসবুক-টিকটকে সখ্যতা। এখন বন্ধুর কাছে বন্ধু নিরাপদ নয়। এত বেশি পড়ালেখার চাপ আর অপসংস্কৃতির প্রভাবে এখনকার বন্ধুরা গ্রামের পরিবেশ খুঁজে পায় না। খেলার মাঠে যায় না। এখন বন্ধুত্ব ফেসবুকমুখী যান্ত্রিকতানির্ভর। এ ধরনের বন্ধুত্বে সুফল নেই।
বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মান্না দের ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’ গানের সুরের সঙ্গে নিজেদের শৈশব, কৈশোর, জীবন ও যৌবন মিলে একাকার, এমনটাই দাবি মিজানুর রহমান মজনু ও ফখরুল আনাম বেঞ্জুর কণ্ঠে।
ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে মজনু বলেন, ‘কফি হাউসের গানটির গীতিকার সব শ্রেণি-পেশার বন্ধুদের একটা গানে তুলে এনেছেন। এটি একটি কালজয়ী অমর গান। এ গান কানে ভেসে এলে এখনো চোখের সামনে বন্ধুরা ঘুর ঘুর করে। আগের দিনগুলো কত সুখময় স্মৃতিতে ভরা ছিল। এখনকার ছেলে-মেয়েরা মান্না দের গান শুনে না। তাদের কাছে এসব গান অপছন্দের। অথচ আমরা গান থেকেও শিখেছি। আমাদের সময়ে গান, চলচ্চিত্র, নাটক কোনো কিছুতে এখনকার মতো বেহায়াপনা ছিল না। আমরা সত্তর দশকে গ্রামে থেকেও একসঙ্গে বন্ধুরা যাত্রা-সিনেমা দেখতাম, মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট খেলতাম। নিজেরা নাটক করতাম আবার লাইব্রেরিতে বইও পড়তাম। এর পেছনে সবচেয়ে দক্ষ বন্ধু হিসেবে আমাদের মা-বাবারা বেশি ভূমিকা রেখেছেন।
ওই দুই বন্ধুর সঙ্গে প্রতিদিন আড্ডা দেন আলাউদ্দিন মিয়া। তিনিও সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। কারমাইকেল কলেজ ছাত্র সংসদের দুবারের সাবেক ভিপি। তার তিন দশকেরও বেশি সময় কেটেছে চাকরিতে। ছাত্ররাজনীতি, সংসারজীবন আর কর্মক্ষেত্র— কোনো কিছুই তাকে বন্ধুদের কাছ থেকে আলাদা করতে পারেনি। প্রাইমারির বারান্দা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে যাদের সঙ্গে হাতে হাত রেখে সখ্যতা ও আন্তরিকতার মোহ গড়েছিলেন, এখন তাদের অনেকেই বেঁচে নেই। যারা বেঁচে আছেন, সে সংখ্যা হাতের আঙুলে গোনা যায়।

ভিপি আলাউদ্দিন মিয়ার বন্ধুদের পরিসর কমলেও অবসর জীবনে এখনো তারা কয়েক বন্ধু নিয়মিত মিলিত হন। সন্ধ্যায় যখন হেলে পড়ে সূর্য, গোধূলির আলোয় বন্ধুত্বের আড্ডা আলোকিত হয়ে ওঠে রংপুর টাউন হল চত্বর। মেতে ওঠেন হাসি-আনন্দে।
সেই আড্ডা প্রসঙ্গে সাবেক এই চাকরিজীবী বলেন, আমরা বয়স, শ্রেণি, চাকরি বা বিচরণ দেখে বন্ধুত্ব করেনি। আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আন্তরিকতা থেকে। এ কারণে এই বয়সেও এসে একদিন কারও সঙ্গে দেখা না হলে আমার মনে শূন্যতা অনুভব হয়। আমরা নিজেরা শুধু গালগল্পে সময় কাটিয়ে যাচ্ছি, তাও না। কখনো কখনো আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যাদের অবস্থা ভালো নয়, তাদের জন্য নিজ নিজ উদ্যোগে বিভিন্নভাবে সহায়তা করছি। এটা সম্ভব হয়েছে যোগাযোগ ঠিক রাখার কারণে।
দেশ-বিদেশে আমাদের অনেক বন্ধু রয়েছে। তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রয়েছে। প্রতিদিনই সুযোগ হলে কারও না কারও সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি, শুধু বন্ধু দিবসেই নয়।
এনএ