প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সাহেদা জানাতে চান শেষ ইচ্ছা
১৯৬৯ সালে রেলযোগে গণসংযোগ করতে রংপুরের কাউনিয়ায় এসেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি কাউনিয়া রেলস্টেশনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য দেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। পরে স্টেশনে সফরসঙ্গীদের নিয়ে খাওয়াদাওয়া করেছিলেন অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সেদিন রান্নাবান্নার আয়োজন ছিল জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান উদ্দিন ওরফে সুলতান মৌলভীর বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুর জন্য ছিল বিশাল আয়োজন। সারা রাত জেগে ব্যস্ত সবাই। সুলতান মৌলভীর স্ত্রী সাহেদা বেগম নিজ হাতে সেসব খাবার রান্না করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্য। তিনিও ছিলেন স্বামীর মতো বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত।
সাহেদা বেগম রাত জেগে রান্না করেন আর ভাবতে থাকেন, সকালে দেখা হবে প্রিয় নেতার সঙ্গে। বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখার অধীর আগ্রহে রাতজাগাকে আর কষ্ট মনে হয়নি। কিন্তু বাধ সাদেন তার শ্বশুর। ঘরের বউ বাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ, শ্বশুরের এমেন কড়া আদেশে স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি সাহেদার।
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলো, বঙ্গবন্ধু কারাবরণ শেষে ফিরে এসে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, ঘাতকদের হাতে নির্মমভাবে সপরিবার নিহত হন। এদিকে স্বামীও মৃত্যুবরণ করেন। তবু এত বছর মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সেই স্মৃতি আজও তার মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন।
বাড়ির পাশে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাকে একনজর দেখতে না পারার আক্ষেপ আজও পোড়ায় সাহেদা বেগমকে। দেশের তরে যার এত অবদান, সেই শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে মনে পড়লেই ভেঙে পড়েন কান্নায়।
এখন সেই শোকাবহ আগস্ট। তাই সেসব স্মৃতি ভাগ করতে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। খবর দিতে চান স্বামীর মৃত্যুর। এ জন্য তিনি দেখা করতে চান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
সম্প্রতি রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হরিশ্বর গ্রামে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সাহেদা বেগমের।
সেই স্মৃতি তুলে ধরে বৃদ্ধ সাহেদা বেগম বলেন, ট্রেনে করে বঙ্গবন্ধু ও তার লোকেরা মিলে সম্ভবত কুড়িগ্রাম সফরে যাচ্ছিলেন। এ কথা শুনে আমার স্বামী সুলতান মৌলভী ভীষণ অস্থির হয়ে ওঠেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু ওই সফরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী অনেকেই ছিলেন। এ কারণে বঙ্গবন্ধু আমাদের বাড়িতে আসতে চাইলেন না। বরং কাউনিয়া স্টেশনে সকালবেলা সবার সঙ্গে দেখা হবে বলে জানিয়ে দেন। এ কথা শুনে আমার স্বামী রান্না-বান্নার সব আয়োজন বাড়িতে করেন।
আমি লোকজন নিয়ে সারা রাত জেগে রান্না করছিলাম। সকালে কাউনিয়া স্টেশনে ট্রেন আসার আগেই সব খাবার পৌঁছে দিয়েছি। রুটি, ডিম সেগ্ধ, হাঁসের মাংস ভুনা, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস, পোলাও, শাকসবজিসহ অনেক রকমের খাবার ছিল। প্রায় তিন শ মানুষের খাবার আয়োজন। এই কাজে একজন রাঁধুনি আমাকে সহযোগিতা করেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর বিপথগামী, উচ্চাভিলাসী ও ক্ষমতালোভী কিছু সদস্য। এই খবর যখন দেশের মানুষকে শোকে স্তব্ধ করে, তখন শোকে মুহ্যমান হন সুলতান উদ্দিন ও সাহেদা। শোকে কেঁদেছিলেন স্বামী-স্ত্রী।
তিনি বলেন, ওই ঘটনা (১৫ আগস্ট) খুব কষ্টের। মনটা ভেঙে গিয়েছিল। আমার স্বামী কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো হয়েছিল। ওরা তো (বিপথগামী সেনাসদস্যরা) শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেনি, ছোট ছেলে শেখ রাসেলকেও হত্যা করেছে। আল্লাহর রহমতে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছে। মানুষ কীভাবে এই পরিবারটাকে শেষ করে দিল? তাদের মনে কি কোনো দয়াময়া ছিল না। ছোট্ট একটা বাচ্চাকেও বাঁচতে দেয়নি! কীভাবে তারা মারল! একটা প্রজন্ম ধ্বংস করে দিল।
কাঁদো স্বরে সাহেদা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমার স্বামীকে ভাই বলতেন। আমরাও তাকে ভাই হিসেবে জানতাম। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনা তো আমার মেয়ের মতোই। এ জন্য আমার স্বামীকে শেখ হাসিনা মৌলভী চাচা বলে ডাকত। একদিন কাউনিয়ায় একটা জনসভার মঞ্চে আমার স্বামী না থাকায় শেখ হাসিনা নিজেই মাইকে ‘মৌলভী চাচা কোথায়?’ বলে খোঁজ করেছিল। পরে আমার স্বামী তার ভাতিজির ডাকে সাড়া দিয়ে মঞ্চে উঠেছিলেন।
স্বামীর মৃত্যুর খবর দিতে চান জানিয়ে তিনি বলেন, আমার স্বামী আজ বেঁচে নেই। ১২ বছর আগে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগে বারবার বলেছিলেন, আমরা যেন তার মৃত্যুর খবরটা শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিই। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারিনি। কিন্তু তার দেওয়া আদেশে আমি এখনো নৌকাতেই ভোট দিই। যত দিন বেঁচে আছি নৌকাতে ভোট দেব। নৌকা আমার ভাইয়ের চিহ্ন। এই নৌকার দিকে তাকালে আমি আমার ভাইকে (বঙ্গবন্ধু) দেখতে পাই, মেয়ে শেখ হাসিনাকে দেখতে পাই। বঙ্গবন্ধুকে সামনাসামনি দেখতে পাইনি, কিন্তু আল্লাহ আমার ভাইকে হাশরের মাঠে ঠিকই দেখা করিয়ে দেবেন।
বঙ্গবন্ধুকে নিজ হাতে খাওয়াতে পারেননি, সেই দুঃখ করে টলমলে চোখে সাহেদা বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য উতলা ছিলাম। সারা রাত জেগে রান্না করেছি, কোনো কষ্ট মনে হয়নি। কখন দেখা হবে, এই অপেক্ষায় সকালে স্টেশনে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার শ্বশুর খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন, তিনি এত মানুষের ভিড়ে যেতে নিষেধ করেছিলেন। এ কারণে কষ্ট করে রান্না করলেও নিজ হাতে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতে পারিনি। এই কথা মনে পড়লে আজও কষ্ট হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাউনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা চারজনের মধ্যে সুলতান উদ্দিন মৌলভী ছিলেন অন্যতম। তিনি রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদেও ছিলেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কখনো অর্থবিত্তের কাছে আদর্শকে বিকিয়ে দেননি। তৃণমূলের রাজনীতিতে থেকেও তিনি বঙ্গবন্ধু, দেশ ও দলের জন্য হয়ে উঠেছিলেন নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক।
মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ না হলেও যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে সুলতান মৌলভী ভারতে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে বহুবার তিনি পাকিস্তানি হায়েনাদের দোসরদের হাতে নির্যাতনের শিকার হন। একবার তাকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রেখে নির্যাতন করেন। কাউনিয়া তিস্তা রেলসেতুর পাশে বেশ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে পাক সেনারা। সৌভাগ্যবশত সুলতান উদ্দিন তার এক ছাত্রের ওসিলায় বেঁচে যান।
২০১০ সালে সুলতান উদ্দিন ১০৪ বছর বয়সে মারা যান। বর্তমানে তার সাত ছেলে-মেয়ের মধ্যে ছয়জন বেঁচে আছেন। তাদের একজন নূরে আলম সাজু। পরিবারের সবার ছোট তিনি।
বাবার স্মৃতিচারণা করে ছেলে সাজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা (সুলতান উদ্দিন) কাউনিয়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। এ কারণে বঙ্গবন্ধুর সফর নিয়ে আমার বাবাসহ কাউনিয়ার আওয়ামী লীগ নেতারা বেশি উজ্জীবিত ছিলেন। সকালে কাউনিয়া স্টেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার সফরসঙ্গীদের নামার কথা ছিল। এ জন্য আগের রাত থেকেই আমাদের বাড়িতে উৎসব চলে, বিরাট রান্নার আয়োজন চলে।
তিনি বলেন, আমি তো এসবের কিছুই দেখিনি। কিন্তু আব্বা, বড় ভাই ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও সংগঠকদের কাছে শুনেছি বঙ্গবন্ধুর কাউনিয়া সফরের গল্প। রান্নাবান্নার আয়োজনে কেউ হাঁস দিয়েছিলেন, কেউ মুরগি দিয়েছিলেন, কেউবা দিয়েছিলেন তরতাজা শাকসবজি। দেশের সবার প্রিয় নেতাকে খাওয়ানোর জন্য সেদিন ছিল অন্য রকম এক আয়োজন। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন সবার আবেগের জায়গা ছিল। আমার মা হয়তো রান্না করেছেন। কিন্তু এতে কাউনিয়ার মানুষের ভালোবাসা জড়িয়ে ছিল। সেদিন শুধু আমার বাবা-মা নয়, পুরো কাউনিয়ার মানুষ উজ্জীবিত ছিলেন।
রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হয়েও সরাসরি রাজনীতিতে নেই কেন, এ প্রশ্নে সাজু বলেন, বাবার মৃত্যুর পর আমাদের পরিবারের কেউ হয়তো দলের সঙ্গে সরাসারি রাজনীতিতে নেই। কিন্তু আমাদের আদর্শ, চিন্তা-চেতনা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার এবং আওয়ামী লীগজুড়ে। কারণ আমাদের এখন কিছুই নেই। সম্পদ বলতে যা ছিল, বেশির ভাগই আমার বাবা দলের পুনর্গঠন ও নেতা-কর্মীদের জন্য ব্যয় করে গেছেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময় থেকে শুরু করে এলাকার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে আমার বাবা নিবেদিত হয়েছিলেন।
বাবা মারা যাওয়ার আগে কয়েক বছর অসুস্থ ছিলেন। এ সময় আমার মা ও আমাদের ছেলে-মেয়েদের তিনি শুধু একটা অনুরোধ করে গিয়েছিলেন, আমরা যেন বাবার মৃত্যুর খবরটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিই। কারণ, শেখ হাসিনা আপা আমার বাবাকে চাচা বলে ডাকতেন। বাবার মৃত্যুর খবর জানতে পারলে প্রধানমন্ত্রী একবার হলেও আমার মায়ের শেষ স্বপ্ন পূরণ করবেন বলে বিশ্বাস করি।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা প্রধানমন্ত্রীকে আমার বাবার মৃত্যুর খবরটি জানাতে পারিনি। কয়েক বছর আগে আমার মা ঢাকায় গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু দেখা করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কিছুই চাই না। শুধু আমার বৃদ্ধা মা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চান, এই ইচ্ছাটা পূরণ হলেই হয়তো আমরা মা সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।
কাউনিয়া মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সরদার আব্দুল হাকিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্বনেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতাযুদ্ধের আগে ও পরে কীভাবে সারা দেশে ঘুরেছেন, এটা কিন্তু সবাই জানে না। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের কাছে গিয়েছিলেন। রংপুরের অনেকেই জানে না যে রেলযোগে গণসংযোগ করতে কাউনিয়ায় বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন। আর সংক্ষিপ্ত সমাবেশে ভাষণও দিয়েছিলেন। সে সময় যারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর দর্শন করেছেন, তাদের অনেকে মারা গেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুলতান উদ্দিন ভাই।
এনএ