ঝুনঝুনির শব্দ শুনেই ক্রিকেট খেলেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা

বিদ্যালয়ের সামনেই ২২ গজের পিচ। একপাশে স্টাম্প। চারদিকে বিভক্ত ফিল্ডাররা। নন-স্ট্রাইকে ব্যাটসম্যান না থাকলেও স্ট্রাইকে বোলিং মোকাবিলায় প্রস্তুত মেহরাব হোসাইন। উইকেটরক্ষক আগে থেকেই হাত প্রসারিত করে বল ধরার জন্য প্রস্তুত। বোলিং প্রান্তে দাঁড়িয়ে ‘ব্যাটসম্যান রেডি?’ ‘ব্যাটসম্যান রেডি?’ বলে যাচ্ছেন বোলার খোকন চন্দ্র বর্মন।
ব্যাটসম্যান মেহরাব ‘ইয়েস রেডি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বল গড়িয়ে ছুড়ে দিলেন খোকন। ব্যাটে-বলে সংযোগ ঘটিয়ে ডান পাশে ঠেলে দিয়ে দুই রান তুলে নিলেন মেহরাব। এতে দলীয় রান সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল ২৬-এ।
এই ক্রিকেট ম্যাচটিতে আর দশটি ম্যাচের মতো ব্যাটসম্যানকে আউট করে প্যাভিলিয়নে পাঠানোর জন্য বল করা হয় না। বরং ব্যাটসম্যানের ব্যাট লক্ষ্য করে বল ছোড়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত সেই বল স্টাম্পে আঘাত করলে আউট হন ব্যাটসম্যান। আর তাতেই আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়েন ক্রিকেটাররা। ক্রিকেট মাঠে নিঃশব্দে বল এসে ব্যাটসম্যানের স্বপ্ন চূর্ণ করলেও এই মাঠে বল ছুটে আসে ঝুনঝুন শব্দ করতে করতে। তারপরও অনেকে ব্যাটে-বলে মেলাতে পারে না। শূন্য হাতে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। কিন্তু তাতে হতাশ হন না তারা। পরের দিন ভালো করার ইচ্ছায় অপেক্ষা করেন। শীত মৌসুমটা ক্রিকেটের মাঠে সময় দিতেই পার হয়ে যায়। বর্ষায় ঘরেই হয়ে ওঠেন একেকজন ফুটবলার। কখনো কখনো দাবা নিয়ে বসে বুদ্ধির ‘মার’ দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেন হাতি-ঘোড়া-মন্ত্রী।
এ সবই বরিশাল সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের নিবাসীদের জীবনের অভিজ্ঞতা। সোমবার (২১ ডিসেম্বর) গোধূলি তখনো ঝাপসা আলো নিয়ে প্রাণ-প্রকৃতি ঢাকতে শুরু করেনি। দেখা গেল তুমুল হইহল্লা। করতালি। উৎসাহ। মাঠের পাশেই বসে ধারাভাষ্য দিচ্ছিল ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রবিউল হোসাইন।
আমরা সব সময়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে কাজ করছি। শিক্ষার্থীরা যেন নিজেরা প্রতিবন্ধী বলে হীনম্মন্যতায় না ভোগে, তারাও যেন নিজেদের স্বাভাবিক মানুষের সমকক্ষ ভাবতে পারে, সেভাবে তাদের গড়ে উঠতে কাজ করা হচ্ছে
আল মামুন তালুকদার, উপপরিচালক, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়
শুধু একদিন নয়, প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের নিয়ে মাঠে নেমে আসেন দুই শিক্ষক-মেহরাব ও খোকন বর্মন। দুই দলে বিভক্ত হয়ে শুরু হয় ক্রিকেট খেলা। কখনো কখনো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। তখন ৫০ ওভারও খেলা হয়ে থাকে।
শিক্ষার্থী রবিউল হোসেন বলেন, খেলাধুলা করতে আমার অনেক ভালো লাগে। বিশেষ করে স্যারদের সঙ্গে যখন খেলি, তখন আমি উৎসাহ পাই। তাদের দ্বারা ভালো ব্যাট-বল করার কৌশল রপ্ত করি। এ ছাড়া ধারাভাষ্যের বিষয়ে রবিউল বলেন, আমি শুনে ধারাভাষ্য দেওয়া শিখেছি। ইংরেজি শব্দ বা বিদেশি শব্দ শুনে শুনে ধারাভাষ্যের সময় প্রয়োগ করি।
কথা হয় শিক্ষক মেহরাব হোসাইনের সঙ্গে। তিনি ঢাকাপোস্টকে বলেন, আমাদের নিজস্ব কোনো মাঠ নেই। সে কারণে স্কুলের সামনেই মাঠ তৈরি করে নিয়েছি। এখানে আমরা প্রতিদিন খেলাধুলা করি। যেহেতু আমরা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, আমাদের আওয়াজ শুনে খেলতে হয়। সে জন্য বলের মধ্যে ঝুনঝুনি ঢুকিয়ে দিয়েছি। আমরা চেষ্টা করছি ন্যাশনাল ব্লাইন্ড টিমের আদলে প্রশিক্ষিত হতে।
নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে মেহরাব হোসাইন বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ওখানেও আমার একটি ক্রিকেট টিম ছিল। ছাত্রাবস্থার সেই আগ্রহ নিয়ে এখনো আমি আমার ছাত্রদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছি। আমার স্টুডেন্টসদের একটা স্বপ্ন আছে, তারা ন্যাশনাল টিমে খেলবে। এখন তো করোনাকালীন অনেক শিক্ষার্থী এখানে নেই। তারা ছুটিতে বাড়ি গেছেন।
আমাদের এখানে ভর্তি শিক্ষার্থী রয়েছেন ৪৮ জন। তবে বর্তমানে ২৫ জন থাকছেন। বাকিরা করোনার ছুটিতে বাড়িতে। নিয়মিত এখানে খেলাধুলা করায় দুটি উপকার হয় বলে জানান মেহরাব। তিনি বলেন, এতে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ফিটনেস ঠিক থাকে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীরা প্রফুল্লমনে জাতীয় টিমের জন্য প্রস্তুত হতে পারছে বলে মনে করেন মেহরাব।
যেকোনো শিক্ষণীয় কর্মকাণ্ডে শিক্ষক ও ছাত্র বলে বিভেদ করা যাবে না। তাহলে দূরত্ব বাড়ে। শিক্ষণীয় কর্মকাণ্ডে একজন শিক্ষককে হতে হবে সহযোগী। তাহলেই শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পাবে। আমরাও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খেলে ওদের তেমন উৎসাহ দিচ্ছি, এমনটাই মনে করেন এখানকার শিক্ষকেরা।
আরেক শিক্ষক খোকন চন্দ্র বর্মন বলেন, বিকেলবেলা আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত ক্রিকেট খেলি। এতে তাদের সঙ্গে একটি ভালো বোঝাপড়া হয়। শুধু ক্রিকেট নয়, আমরা শিক্ষক-শিক্ষার্থী মিলে বিভিন্ন ধরনের ইনডোর গেইম খেলে থাকি।
এ বিষয়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আল মামুন তালুকদার ঢাকাপোস্টকে বলেন, আমরা সব সময়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে কাজ করছি। শিক্ষার্থীরা যেন নিজেরা প্রতিবন্ধী বলে হীনম্মন্যতায় না ভোগে, তারাও যেন নিজেদের স্বাভাবিক মানুষের সমকক্ষ ভাবতে পারে, সেভাবে তাদের গড়ে উঠতে কাজ করা হচ্ছে।