গণসমাবেশ নিয়ে যা বললেন খুলনার আ.লীগ-বিএনপি নেতারা

খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো শনিবার। এই সমাবেশ নিয়ে খুলনা জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা পাল্টাপাল্টি নানা অভিযোগ, মন্তব্য ও দাবি করেছেন।
সবশেষ রোববার দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগ নেতারা বলেন, সমাবেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা মিথ্যাচার ও উস্কানিমূলক বক্তব্য রেখেছেন। তাদের নেতা-কর্মীরা খুলনা রেলস্টেশন ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড আ.লীগ অফিস ভাঙচুর করেছেন।
সমাবেশের আগে থেকে পরিবহন বন্ধ থাকার বিষয়ে তারা বলেন, এই অঞ্চলের মালিক-শ্রমিকরা নিরাপত্তার স্বার্থে এবং তাদের কয়েকটি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পরিবহন বন্ধ রেখেছিলেন। এর সঙ্গে সরকার বা আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিকেলে নগরের কে ডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে করে বিএনপি নেতারা বলেন, ক্ষমতাসীনদের ক্যাডার ও পুলিশের হামলায় গণসমাবেশে অংশ নিতে গিয়ে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার করা হয়েছে মহানগর বিএনপির সদস্য খন্দকার হাসিনুল ইসলাম নিকসহ ১৩৭ জনকে।
তারা বলেন, রেলওয়ে থানা ও দৌলতপুর থানায় নেতা-কর্মীদের নামে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। শত বাধা ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে শান্তিপূর্ণভাবে গণসমাবেশ সফল করার পরও পুলিশ ও শাসকদলীয় ক্যাডারদের সম্মিলিত তাণ্ডবে এখনো খুলনাজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব চলছে।
খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শেখ হারুনুর রশীদ বলেন, বিভাগের ১০ জেলা থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপির মিথ্যা অভিযোগ, উস্কানি ও নানা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের মুখে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগ অনেক ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। তাদের ফাঁদে পা দেয়নি। অবশেষে বিভাগীয় গণসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় এটিই প্রমাণিত হয় যে, আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। বিরোধী পক্ষকে সভা সমাবেশ করতে দেয়।
তিনি বলেন, গণসমাবেশ সুষ্ঠুভাবে শেষ হওয়ায় সোনালী ব্যাংক চত্বর ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়ায় সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষকে এবং মাইক ব্যবহারসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে অনুমতি দেওয়ায় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে খুলনা জেলা ও মহানগর বিএনপি। এতেই প্রমাণিত হয় গণসমাবেশে কোনো ধরনের বাধা দেওয়া হয়নি। তবে কেন এই মিথ্যাচার করা হলো?
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, গণমাধ্যম সঠিক সংবাদ পরিবেশন করবে- এটিই জনগণ প্রত্যাশা করে। কিন্তু গণসমাবেশকে কেন্দ্র কোনো কোনো প্রচার মাধ্যমে অতি উৎসাহী, অতিরঞ্জিত ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ পরিবেশন জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার কথা থাকলেও তাদের নেতা-কর্মীরা খুলনা আধুনিক রেলওয়ে স্টেশনে ভাঙচুর চালিয়েছেন। নগরের দৌলতপুর এলাকার নতুন রাস্তা মোড়ে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা- ভাঙচুর করা হয়েছে। এতে দুজন আহত হয়েছেন- যারা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ সময়ে একটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করা হয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা নগরের শিববাড়ী মোড় টাইগার গার্ডেন হোটেলের সামনে চারটি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করেন। এতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের আটজন নেতা-কর্মী আহত হন। অথচ এসব সংবাদ অনেক পত্রিকায় আসেনি। একপেশে সংবাদ পরিবেশন করায় জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি বাবুল রানা, জেলা সাধারণ সম্পাদক সুজিত কুমার অধিকারী, সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান বাবু, কামরুজ্জামান জামাল, আশরাফুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মো. সাইফুল ইসলাম, সৈয়দ আলী, সফিকুর রহমান পলাশ, আসাদুজ্জামান রাসেল প্রমুখ।
অন্যদিকে দলীয় সংবাদ সম্মেলনে মহানগর বিএনপির শফিকুল আলম মনা বলেন, কর্মসূচি সফল করতে আমরা সমাবেশের আগেই একাধিক দফায় পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের সহায়তা চেয়েছিলাম। পুলিশ কমিশনার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। পরিবহন বন্ধ করা হয়েছে। লঞ্চ চলাচল, ট্রলার চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। খুলনায় আসার পথে নেতা-কর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলা হয়েছে। অনেক স্থানে পুলিশও বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়েছে।
তিনি বলেন, সকালে আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপির কর্মসূচি নিয়ে মিথ্যাচার করেছে। বিএনপির নিউজ কাভারেজ করার কারণে সেখানে প্রচ্ছন্নভাবে সাংবাদিকদের শাসানো হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন। খুলনা জেলার পরিস্থিতি তুলে ধরেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, খুলনা মহানগরের সব থানায় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। দিনভর সশস্ত্র অবস্থায় মোটরসাইকেল মহড়া এবং অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দিয়েছে। আগে থেকেই গণপরিবহন বন্ধ ছিল। প্রায় অচল নগরে জরুরি প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের মহড়ায় তারাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছেন। আওয়ামী ক্যাডাররা হামলা চালিয়ে মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. তারিকুল ইসলাম জহিরের মালিকানাধীন আছিয়া সি ফুড- প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করেছে। সাবেক কাউন্সিলর ও নগর বিএনপির সদস্য কে.এম হুমায়ুন কবিরের বাসভবনে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলা হয়েছে কাউন্সিলর হাফিজুর রহমান মনির বাসভবনেও।
আরও বলা হয়, খানজাহান আলী থানা বিএনপির নেতারা নদীপথে খুলনায় আসছিলেন। খালিশপুরের আলমডাঙ্গায় প্রথম দফায় এবং পরে ট্রলার ঘুরিয়ে বিএল কলেজ ঘাটে নেমে নতুন রাস্তা ধরে মিছিল করে খুলনায় আসার পথে বিডিআর ক্যাম্পের দ্বিতীয় দফায় হামলার শিকার হন।
হামলায় আহতরা হলেন আলমগীর হোসেন, মো. মাসুম বিল্লাহ, বিল্লাল হোসেন, হাবিবুর রহমান বিপ্লব, স্বাধীন মোল্লা, আবুল হায়াত শুভ, রফিকুল ইসলাম, সাইফুল্লাহ তাজিন, মামুন, মো. তরিকুল ইসলাম, মো. আলী হোসাইন, মো. সবুজ শেখ, মো. সজল শেখ, ওয়াহিদুল ইসলাম ওয়াহিদ, জাফর শেখ, আলিমুর রহমান, নুর ইসলাম, জাহাঙ্গীর হোসেন খোকা, আলম মোল্লা, মঞ্জুরুল ইসলাম মোল্লা, মনু শেখ, আশিকুর রহমান, আব্দুস সামাদ মাস্টার, শেখ ইকরাম হোসেন, শেখ শাহাজাহান, মনিরুল ইসলাম মনু, ইলিয়াস সেখ, সেখ আলমগীর হোসেন, বাবু শেখ, ইমরান হোসেন, শাহরিয়ার, জাহাঙ্গীর হোসেন, আবির হোসেন, বাচ্চু, সুজন, জাহিদ, বাপ্পি, শামিম, মো. রিপন, সিয়ামুর রহমান, ফয়সাল, মো. সোহাগ হোসেন, বাবুল হাওলাদার, মো. ফারুক শেখ, মো. সিদ্দিকুর রহমান, শেখ আজিজুর রহমান, মো. জব্বার, শেখ শাহাজাহান, মো. সাইদুজ্জামান, বারেক হাওলাদার, মো. শহীদ শেখ, মো. জসিম ও মিলন।
লিখিত বক্তব্যে আরও বলা হয়, ৩১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আমীন আহমেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়েছে। আড়ংঘাটা থানার মতলেবুর রহমান মিতুল, আয়েশা বেগম, ফিরোজা খাতুন, নারায়ন মিশ্র, হান্নান মোড়ল, রকিবুল ইসলাম, হৃদয় বিশ্বাস, এহসানুল ইসলাম শিথিল, মহিদুল ইসলাম, শাহজালাল বাদশা, মানিক সরদার, মো।। ইখলাস মোড়ল, হাবিব শেখ, আ. রহিম, গোলাম রব্বানী, সোহান শেখ, শেখের ওপর নতুন রাস্তার মোড়ে ৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শামসুজ্জামান প্রিন্সের নেতৃত্বে সেদিন হামলা হয়। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে মুনসুর বাবলু, আব্দুল মতিন বাচ্চু ও আলী আজগর, ১ নম্বর ওয়ার্ডের শাহরিয়ার তপু, পারভেজ মিজান, হিমু, বাবু, মঈনুল, মাজেদুল ইসলাম হামলায় আহত হয়েছেন। আড়ংঘাটা থানা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক রাজা উর রহমান প্রিন্সও সন্ত্রাসী হামলায় আহত হন। এ ছাড়া পুলিশ বিএনপি নেতাদের বাড়িতে গিয়ে ভয়-ভীতি দেখানোর পাশাপাশি ও মামলার আসামি করার হুমকি দিচ্ছে। মহানগর যুবদল নেতা সালাউদ্দিন, ১৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা আব্দুস সালাম হাওলাদার, আব্দুল জলিল হুমকি পেয়ে ঘরছাড়া।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আমীর এজাজ খান বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীরা গুলি করে ইউপি চেয়ারম্যান আবুল বাশারকে গুরুতর আহত করেছে। পাইকগাছা বিএনপির সভাপতি ডা. আব্দুল মজিদ, সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক, ডুমুরিয়া সভাপতি মোল্লা মোশারফ হোসেন মফিজ, দিঘলিয়া সভাপতি সাইফুর রহমান মিন্টুর বাড়িতে হামলা ও মহড়া হয়েছে। ব্যাপক তাণ্ডব চলেছে ফুলতলা উপজেলায়। তেরখাদা, দিঘলিয়া, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, রূপসা সর্বত্র হামলা ও মহড়া হয়েছে।
এ সময় জানানো হয়, সোমবার দুপুর ১২টায় কে ডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ে আরেকটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সেখানে বক্তব্য রাখবেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পী, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. তারিকুল ইসলাম জহির, আবু হোসেন বাবু প্রমুখ।
মোহাম্মদ মিলন/আরএইচ