রাজবন বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু

বেইনঘর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে রাঙামাটির রাজবন বিহারে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী ৪৯তম শুভ দানোত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। রাঙামাটির রাজবিহারের চীবর দান উৎসবই পার্বত্যাঞ্চলে বৌদ্ধদের বৃহত্তম কঠিন চীবর দানোৎসব। এই উৎসবে দেশ-বিদেশের লাখো পুণ্যার্থী অংশ নেন।
বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) দুপুরে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় বেইনঘর উদ্বোধন করেন। এসময় রানি ইয়েন ইয়েন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির।
উদ্বোধনের পর চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীয় রায় বলেন, গত দুই বছর করোনার কারণে বৃহৎ এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হয়নি। যেহেতু বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে এখন কোভিডের প্রকোপ কম তাই রাজবন বিহার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই বছর আবারো চীবর দান অনুষ্ঠানটি করবেন। রাঙামাটি জেলার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক জেলা থেকে ২৪ ঘণ্টায় চীবর তৈরি করে সেটি দান করার এই প্রথায় অংশ নেওয়ার জন্য অনেকেই এসেছেন। তাদের আমি ধন্যবাদ জানাই। পাশাপাশি এই পুণ্যাহনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বের মঙ্গল ও শান্তি কামনা করি।
রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী বলেন, গত দুই বছর কোভিডের কারণে চীবর দান অনুষ্ঠান হয়নি। তাই এই বছর সবার মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনাটা অনেক বেশি। আমি আশা করি এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভগবান গৌতম বুদ্ধের আদর্শ সকলের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে।
রাঙামাটি রাজ বনবিহার উপাসক-উপাসিকা কার্যনির্বাহী পরিষদের সহসভাপতি শিক্ষাবিদ নিরুপা দেওয়ান বলেন, বৌদ্ধ ধর্মীয় নিয়ম ও নীতি অনুযায়ী এই কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠানটি হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমার তিনমাস পর প্রবারণার পূর্ণিমার পরপরই এই চীবর দান অনুষ্ঠানটি হয়। ভগবান গৌতম বুদ্ধের উপাসিকা বিশাখা ভগবানের কাপড় ছেড়া দেখতে পেয়ে এক রাতের মধ্যে তুলা থেকে সুতা, সুতা থেকে চীবর তৈরি করে ভগবানকে দান করেন। সেই থেকে এই সংস্কৃতি চলে আসছে।

শুক্রবার (৪ নভেম্বর) সকালে বুদ্ধ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে এই দিনের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে দেব-মানবের তথা সকল প্রাণীর হিতার্থে ধর্মদেশনা। ধর্মদেশনায় উপস্থিত থাকবেন রাজবন বিহারের আবাসিক প্রধান শ্রীমৎ প্রজ্ঞালঙ্কার মহাস্থবির। দুপুরে গৌতম বুদ্ধ ও বনভান্তের প্রতিকৃতিতে চীবর দান করা হবে।
চীবর তৈরির কাজে অংশ নেওয়া উপাসিকা সুরভী চাকমা বলেন, আমি জুরাছড়ি থেকে এসেছি। আজ সারারাত আমরা বেইন বুনবো এবং আগামীকাল ভিক্ষু ও বনভান্তের চরণে এগুলো সমর্পন করব।
তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণভাবে রাঙামাটি রাজবন বিহারে প্রতিবছর এ দানোৎসবের আয়োজন করা হয়। এদিকে উৎসব উপলক্ষে রাজবন বিহার এলাকায় বিশাল মেলা বসেছে। মেলা প্রাঙ্গণে সহস্রাধিক স্টলে সারাদেশ থেকে কুটির ও হস্তশিল্পের পণ্যের পসরা নিয়ে লোকজন এ মেলায় অংশ নিয়েছে। এছাড়া নাগরদোলাসহ বিভিন্ন খেলা, যাদু প্রদর্শনী, ধর্মীয় পালাকীর্তনের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
মেলায় পসরা সাজিয়ে বসা দোকানি সাজু চাকমা বলেন, আমি আমার নিজের বাগানে উৎপাদিত ডাব, শসা, বেগুন নিয়ে এসেছি মেলাতে বিক্রি করতে। প্রতিবছরই আমরা অনেকে এই মেলায় অংশ নিই। আমাদের বিক্রি ভালোই হয়। শুধু ফলমূল নয়, অনেকে বাসায় বানানো পিঠাসহ নানান খাবারও নিয়ে আসেন।
উল্লেখ্য, গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাউপাসিকা বিশাখা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা এবং সুতা রঙ করে কাপড় বুনে তা সেলাই করে চীবর (ভিক্ষুদের পরিধেয় বস্ত্র) দান করে এই কঠিন চীবরদানের সূচনা করেন প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। এই পদ্ধতিতে দান করলে কায়িক, বাচনিক মানসিকভাবে অধিক পরিশ্রম হয় এবং অধিকতর পূণ্যলাভ হয় বলে বৌদ্ধ শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) রাঙামাটি জেলার লংগদু উপজেলার তিনটিলা বন বিহারের দায়ক-দায়িকাদের দিয়ে এই কঠিন চীবর দানোৎসবের পুনঃপ্রবর্তন করান।
রাঙামাটি রাজবন বিহারে সর্বপ্রথম কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৪ সালে। সেই থেকে প্রত্যেক বছর রাঙামাটি রাজবন বিহারসহ তিন পার্বত্য জেলার রাজবন বিহারের শাখাসমূহে বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মে কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
মিশু মল্লিক/এমজেইউ