‘ব্যাটারা দ্যাকে না জন্তে বুড়া বয়সোতও ফুল বেচা নাগে’

‘বাবারে আগের মতো কাম-কাজ নাই। মুই বয়স্ক মানুষ, শরীর আর আগের মতো কুল্যায় না। তারপরও টেনেটুনে সংসার চালাবার চেষ্টা করি যাওছো। কিন্তুক যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে টিকাই মুশকিল হয়্যা গেইছে। ফুল বেচে যা কামাই হয়, তাকে দিয়্যা খালি কোনো মতে দিন যাওছে। কাউন্সিলারোক কত কনু কোনো ব্যবস্থা করিল না বাহে।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে বিপাকে পড়া আব্দুর রহমান। খাল-বিল-পুকুর থেকে পদ্ম ও শাপলা ফুল তুলে এনে বিক্রি করেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (০৩ নভেম্বর) দুপুরে রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) চত্বরে ডালি ভর্তি লাল-সাদা শাপলা ফুল নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় আব্দুর রহমানকে। সপ্তাহে চার দিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কলেজ গেটের সামনে বসে শাপলা ও পদ্ম ফুল বিক্রি করেন তিনি। অন্য দিনগুলো শহরের বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে ফেরি করে ফুল বিক্রি করেন। তার কাছ থেকে শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা ছাড়াও সাধারণ মানুষজন ফুল কিনে থাকেন। ফুল বিক্রির অর্থে তার সংসার চলে।
আব্দুর রহমানের বসবাস রংপুর নগরীর বাহাদুর সিং মাস্টার এলাকায়। তার দুই ছেলে সন্তান রয়েছে। কিন্তু বিয়ের পর সন্তানরা মা-বাবাকে ছেড়ে নিজেদের সংসারের হাল ধরেছেন। তাই ৬০ বছর বয়সেও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার চালাতে লড়াই করছেন তিনি। কৃষিশ্রমিক হওয়ায় সবসময় কাজ জোটে না তার। এ কারণে আব্দুর রহমান ও তার স্ত্রীকে কখনো অর্ধাহারে নয়তো অনাহারে দিন পার করতে হয়েছে। এখন না খেয়ে থাকার সেই কষ্ট নেই। কিন্তু নিত্যপণের লাগামহীন দাম বৃদ্ধিতে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

জানা গেছে, ৮ বছর আগে জীবিকার তাগিদে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে ফুল বিক্রি শুরু করেন আব্দুর রহমান। সেই পুরোনো দিনের স্মৃতি কথা বলতে গিয়ে এই ফুল বিক্রেতা বলেন, মুই বাবা নিম্ন আয়ের মানুষ। হাতোত কোনো পুঁজি নাই। ওই তকনে শরীর না চললেও কিছু করি খাওয়া নাগবে। ফুল বেঁচাইলে ভাত জোটে, তা না হইলে বাড়ির চুল্যাত হাড়ি উঠে না। শহর-গ্রামের বিভিন্ন এলাকার খাল-বিল, পুকুর-ডোবা থাকি ফুল কুড়ি আনি ব্যাচাং। যা আয় হয় সেই টাকা দিয়্যা মোর সংসার চলে।
২০১৪ সালে বুড়িরহাটের পাশে চেংমারীর বিলে অগণিত শাপলা ফুল দেখার পর থেকে তিনি ফুল বিক্রির চিন্তা করেন। এরপর প্রতিদিন ভোরে বাড়ি থেকে বের হয়ে বিলের পানিতে নেমে শাপলা ফুল তুলে হাট-বাজার, স্কুল-মাদরাসার সামনে কিংবা জনসমাগম ঘটে, এমন জায়গায় ফেরি করে ফুল বিক্রি শুরু করেন। তখন ফুল বিক্রিতে যা রোজগার হতো তা দিয়ে টেনেটুনে তার সংসার চলত। শুরুতে একটি ফুলের আঁটি ১০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে একটি ফুলই ৫-১০ টাকায় বিক্রি করছেন।
আব্দুর রহমান জানান, শুরুতে তিনি শাপলা ফুল বিক্রি করতেন। এখনও শাপলা ফুলই বেশি বিক্রি করে থাকেন। তবে কখনো কখনো তার ফুলের ডালিতে পদ্মও শোভা পায়। বুড়িরহাট, গঙ্গাচড়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে তিনি শাপলা ফুল সংগ্রহ করেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১৫-২০ আঁটি ফুল তুলতে পারেন তিনি। এরপর সেগুলো এনে রংপুর মেডিকেল কলেজ, সিটি বাজার, টাউন হল, কাচারি বাজার, লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ফেরি করে বিক্রি করেন। সাধারণ মানুষের চেয়ে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই তার কাছ থেকে বেশি ফুল কিনে থাকেন।
আগে কৃষিকাজ করে যা আয় হতো তা দিয়ে ভালোভাবেই সংসার চালানো সম্ভব ছিল দাবি করে তিনি বলেন, আগোত জিনিসপত্রের দাম খুব কম ছিল। কামলা দিয়্যা যা পাচনো তা দিয়্যা সংসার ভালোয় চলেছে। এ্যলা তো কামলার দাম বাড়ছে, সঙ্গে জিনিসপত্রের দামও। সারা দিন ফুল বেঁইচা ৪০০-৫০০ টাকা কামাই হয় কিন্তু খরচপাতি করি শান্তি নাই। একদিনোতে সোগ টাকা ফুরি যায়। মোর দুইটা ব্যাটা মাইনষের দোকানোত কাম করে, ওমরা হামার খোরাকি দিবার পারে না। ওই তকনে এই বুড়া বয়সোতও মোকে ফুল ব্যাচাবার নাগোচে।
আব্দুর রহমান বলেন, শীতের আগ পর্যন্ত বিল থাকি শাপলা তুলি বিক্রি করি। কিন্তু আগের মতো এ্যলা ঘাড়োত বাউংক্যা নিয়্যা ঘুরব্যার পারো না। অল্প একন্যা হাঁটলে ক্যানবা পাও ফুলি যায়, আইতো ব্যথা করে। ওই তকনে বেশির ভাগ সময় মেডিকেলের গেটোত বসি থাকোং। সরকার গরিবের জন্তে কত কিছু করোছে। কিন্তুক হামার কাউন্সিলর আইজ পর্যন্ত মোক একটা কার্ড দিলে না। গ্রামের ম্যালা মাইনষে টিসিবির কার্ড পাইছে বাহে। খালি মুইয়ে পাও নাই। কার্ড কোনা থাকলে একনা কম দামে জিনিসপত্র কিনিবার পানু হয়।
আব্দুর রহমানের কাছ থেকে যারা ফুল কিনে নেন, তাদের কেউ প্রিয়জনদের উপহার দেন। আবার কেউ রান্নার জন্য নয়তো পূজা-অর্চনার জন্য নিয়ে থাকেন। দিনে দিনে নগরায়নের ফলে খাল-বিল, পুকুর-ডোবার সংখ্যা কমতে থাকায় আগের মতো শাপলা ফুল সংগ্রহ করতে পারছেন না তিনি। সঙ্গে তার মতো আরও অনেকেই শহরে ফেরি করে ফুল বিক্রি করায় তার আয় কিছুটা কমতে শুরু করেছে বলেও জানান আব্দুর রহমান।
ফুল কিনতে আসা রংপুর মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ নবাব বলেন, প্রায়ই আব্দুর রহমান চাচার কাছ থেকে শাপলা ফুল কিনে থাকি। বিশেষ করে আমাদের কোনো পার্টি হলে, কখনো কোনো অতিথি এলে তাদের শাপলা ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি