৩৫ বছর ধরে অন্ধকারে পথ পরিষ্কার করছেন লাইলীরা

যখন স্বামী-সন্তান বা পরিবারের অন্যরা ঘুমে, তখন ঘরের বাইরে তারা। আবার সড়কে মানুষের সমাগম হওয়ার আগেই ঘরে ফিরে যান। তাদের এই যাওয়া-আসা সহসাই কারও চোখে পড়ে না। দেখাও হয় না তাদের কাজ। অথচ প্রতিদিন ভোর হয়, সূর্য ওঠে, তারও আগে জেগে উঠতে হয় তাদের। একেক প্রান্তে একেকজনের ছুটে চলা আর কয়েক ঘণ্টার ক্লান্তিহীন শ্রমে যত্রতত্র পড়ে থাকা অপরিচ্ছন্ন নগর হয় ময়লা-আবর্জনামুক্ত। বলছিলাম একটা পরিচ্ছন্ন নগরের গল্প বুননের প্রথম সারির নারী যোদ্ধাদের কথা।
ময়লা-আবর্জনা আর দুর্গন্ধ হজম করা এই নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বাঁচার লড়াইটা ঝকঝকে সড়কের মতো নয়। কম বেতন অথবা চুক্তিভিত্তিক হাজিরার সামান্য টাকাই তাদের অনেকের জন্য বড় উপার্জন। টানাটানির সংসারে কোনো রকমে খেয়েপরে বেঁচে থাকতে জীবিকার তাগিদে বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও এ পেশাতেই রয়েছেন তারা।
ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করার কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ারও খবর মিলছে। তারপরও সংসার, সন্তান, পরিবারের দিকে চেয়ে কাকডাকা ভোরে বিছানা ছেড়ে ঝাড়ু হাতে ঘরের বাইরে আসেন। ফিরে যান একেকটা পরিচ্ছন্ন সড়ক ও অলিগলি উপহার দিয়ে।
অথচ ফুটপাত-রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা থেকে দূরে থাকার কত চেষ্টা সবার। দুর্গন্ধে কখনো হয় বিরক্তি ভাব। আবার অনেকেই ময়লা-আবর্জনা দেখলেই দূর দিয়ে হাঁটেন। নাকে রুমাল ধরে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ পার হওয়াটা যেন কারও কারও জন্য চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই ময়লা-আবর্জনাকে নিয়েই চলে কিছু মানুষের জীবন। তারা প্রতিদিন ঝাড়ু হাতে লোকচক্ষুর আড়ালে নগর পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করেন। তাদের পরিচয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী।
রোববার (৭ মার্চ) মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত রংপুর নগরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অনেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী দেখা গেছে। যাদের বেশির ভাগই নারী। রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় তিনটি জোনে ভাগ হয়ে কাজ করছেন তারা। যাদের একেকজনের জীবনের গল্প একেক রমকের। হাসি-কান্না-বেদনায় ভরা এ জীবনে তাদের সবার চাওয়া একটু ভালো থাকা, টিকে থাকার মতো বেতন পাওয়া।
নগরীর গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে ঝাড়ু হাতে ময়লা-আবর্জনা জড়ো করতে দেখা যায় জরিনা বেগমকে। কাছে গিয়ে জানা গেল তার স্বামী বেঁচে নেই। তিন সন্তানের মধ্যে কিছুদিন আগে বড় ছেলেও মারা গেছেন। এখন নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকায় ছেলের বউ, বাচ্চা আর নিজের ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন জরিনা।
ঢাকা পোস্টকে এই নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ২০ বছর ধরি ঝাড়ু দেই। এই কাজ খুব কষ্টের। হাজিরা কম। তারপরও পেটের জন্যে ঝাড়ু হাতোত তুলি নিচি। স্বামী নাই, ছেলেও মরি গেইছে। খুব কষ্ট করি সংসার চালাই। ব্যাটার বউ-ছাওয়া, নিজের ব্যাটা-বেটিট (ছেলে-মেয়ে) নিয়্যা আছি। প্রত্যেক দিন সূর্য উঠার আগোত ঘুম থাকি উঠি রাস্তা ঝাড়ু দেই। আবার সকালে মাইনসের ম্যাসোত (ছাত্রবাসা) রান্না করি। এমন করিয়া জীবনটা যাওচে।
জরিনা বলেন, যা টাকা পাই, তা দিয়ে তো সংসার চলে না। তারপরও কাজ করি। ঠিকমতো ভালো খাই না। শরীরও আগের মতো চলে না। জীবনটাত অনেক কষ্ট, দুঃখ। রাস্তা ঝাড়ু দিয়্যা যা বেতন হয়, মাইনসের দ্যানা (ঋণ) শোধ করতে শ্যাষ। এই সামান্য টাকাত নিজের অসুখ-বিসুখ হইলে চিকিৎসা করারও উপায় নাই। কিন্তু বাচি থাকার জন্য তো কিছু করা লাগবে, এই জন্যে ঝাড়ু দেই।
গ্র্যান্ড হোটেল মোড় সড়ক ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় রাশেদা বেগম নামে আরেক নারী পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে। ছালেক পাম্পের পাশে ঝাড়ু দিয়ে ময়লা-আবর্জনা সরাতে ব্যস্ত এই নারী ঢাকা পোস্টকে জানান, ২২ বছর ধরে রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করছেন। ভোরবেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেভাবে রাস্তাঘাট-ফুটপাত পরিষ্কার করি, কিন্তু সেই পরিশ্রম হিসেবে সে রকম বেতন নেই। যা বেতন দেয়, তা খুব কম। কষ্টার্জিত উপার্জন দিয়ে ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ জোগান।
নগরীর মুন্সিপাড়া এলাকায় সপরিবার বাস করেন রাশেদা। প্রতিদিন ভোর চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঝাড়ু দেন রাশেদা। তার স্বামী ভ্যানে করে ময়লা-আবর্জনা সরানোর কাজ করেন। দুজনের পরিশ্রমে যা আয় হয়, তা দিয়ে ছেলেদের পড়ালেখা আর টানাপোড়নের সংসার চলছে।
সাতগড়া মিস্ত্রিপাড়া থেকে হেঁটে হেঁটে নগরীর সেনপাড়া এলাকায় আসেন আনোয়ারা বেগম। প্রতিদিন সূর্য ওঠার আগেই নিজের দায়িত্বে থাকা রাস্তার এপাশ-ওপাশ পরিষ্কার করেন। সড়কে লোকসমাগম হওয়ার আগেই আবার ফিরে যান বাড়িতে। মায়ের অসুস্থতার কারণে স্বামী-পরিত্যক্তা এই নারী ঝাড়ু হাতে লড়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন। ঢাকা পোস্টকে আনোয়ারা বলেন, উপার্জনের অন্য কোনো পথ নেই। ছোট থাকতেই বাবা মারা গেছেন। আর স্বামীর সংসারে সুখ মেলেনি। এখন মায়ের সঙ্গে থাকি। সেই মা অসুস্থ হওয়ায় রাস্তা ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করছি। আমরা খুবই অসহায়। থাকার মতো জায়গা নেই। মানুষের জায়গায় থাকি।
এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই দুঃখেকষ্টে বড় হয়েছি। এত কষ্ট বোধ হয় কারও হয় না। আমার মা আমাদের জন্য অনেক কষ্ট করেছে। এখন মা অসুস্থ। এ জন্য আমি নিজের মানসম্মানের দিকে না তাকিয়ে ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করছি। শুধু ঝাড়ু দিয়ে তো সংসার চালানো সম্ভব না। মানুষের বাড়িতে কাজ করি। মাস শেষে যা টাকা পাই, তা দিয়ে সন্তানের লেখাপড়া আর মায়ের ওষুধ কিনি। এত কষ্টের মধ্যেও খুব ভালো লাগে যখন কেউ প্রসংশা করে। সাহস দেয় অনুপ্রেরণা দেয়।
৪০ বছর ধরে রাস্তায় ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করছেন আয়শা সিদ্দিকা। থাকেন নগরীর মুলাটোল এলাকায়। রোববার ভোর ছয়টার দিকে সেন্ট্রাল রোড ঝাড়ু দেওয়ার ব্যস্ততার ফাঁকে তিনি কথা বলেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে, চাকরির শুরু হয়েছিল ১২০ টাকা বেতনে। তখন রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন মোহাম্মদ আফজাল। এরপর বেতন বেড়ে পর্যায়ক্রমে ১৮০, ৩৮০, ৫২০ টাকায় যায়। পরে আবার কাজী জুননুন ও মেয়র আব্দুর রউফ মানিকের সময়ে বেতন বেড়ে ৮২৭ থেকে ১৫০০ টাকা হয়। বর্তমান মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার তাদের বেতন বাড়িয়ে ২২০০ টাকা পর্যন্ত করেছেন। করোনাকালে সবাই যখন ঘর থেকে বের হয়নি, তখনো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রেখেছেন। কিন্তু প্রণোদনার বেলায় সিটি করপোরেশন থেকে পেয়েছেন মাত্র ৫০০ টাকা করে।
আয়শা সিদ্দিকা বলেন, আমার স্বামী পঙ্গু ছিল। ভিক্ষা করত। সংসারে খুব অভাব ছিল। তখন থেকেই ঝাড়ু দেওয়ার কাজ করছি। তিনটা ছেলে আর দুইটা মেয়ে আছে। এদের মধ্যে তিন ছেলে সিটিতে ময়লা-আবর্জনা সরানোর কাজ করে। একটা মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এই বয়সেও ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনা করতে হয়। খুব কষ্টে আছি। শরীরের দিকে দেখলে বুঝবেন, সুখে আছি না দুখে আছি।
একই কথা বলেন নগরীর নূরপুর এলাকায় বসবাস করা পরিচ্ছন্নতাকর্মী লাইলী বেগম। ৩৫ বছর ধরে ঝাড়ু দেওয়া ও নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করে যাওয়া এই নারী ঢাকা পোস্টেকে বলেন, আমার স্বামী নাই। ছেলে-মেয়েও নাই। একটা মেয়ে ছিল, সেও মারা গেছে। এখন নাতি-নাতনিদের দেখতে হয়। ঝাড়ু দিয়ে আর রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কাজ করে যা হয়, তাই দিয়ে চলছে।
এদিকে রংপুর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা (জোন-৩) শাহিনুর রহমান শাহিন ঢাকা পোস্টকে জানান, প্রায় ৭৫০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী সিটি এলাকার তিনটি জোনে কাজ করছেন। তাদের মধ্যে ৭৫ ভাগ কর্মীই নারী। যারা মধ্য রাত থেকে সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করেন। তাদের কারণে নগরবাসী সকালে বের হয়েই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও আবর্জনা-দুর্গন্ধহীন নগর উপহার পাচ্ছেন।
এনএ