অকূল পাথারে পড়া নারীদের সংগ্রাম

কেউ বিক্রি করছেন সবজি, কেউবা মাছ-মাংস; আবার কেউ মুদি দোকানি— তারা কেউই পুরুষ নন, সবাই নারী। ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর এলাকায় মালঞ্চ ও আদর্শ নামে দুই কলোনি ঘিরে গড়ে ওঠা একটি বাজারে গেলে দেখা মিলবে এমন দৃশ্যের।
এখানে বহু সংগ্রামী নারী বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে নিজেরাই চালাচ্ছেন তাদের সংসার। যাদের কেউ হারিয়েছেন স্বামী, কারও স্বামী অসুস্থ আবার কারও ভেঙেছে সংসার। এই বাজারে পণ্য বিক্রি করে এভাবেই চলছে তাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম।
জানা গেছে, ৩০ বছর আগে রাস্তায় বসে কিছু পণ্য বিক্রি করতেন ওই দুই কলোনির অসহায় কয়েকজন নারী। সংসারের অভাব ঘোচাতে তারা চিন্তা করলেন নারীদের নিয়ে একটি বাজার শুরু করার। যেখানে বিক্রেতা থাকবেন নারীরাই। এরপর সিটি করপোরেশনের জমিতে গড়ে ওঠে এ বাজার।
শুরুতে পাঁচ-ছয়টি দোকান থাকলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩০-এ। বাজারের হর্তাকর্তা নারীরা বলে লোকমুখে বাজারটি এখন পরিচিত ‘বউবাজার’ নামে।
বাজারে ব্যবসা করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অনেক অসহায় নারী। তাদেরই একজন রাশিদা বেগম (৬৫)। ৮ বছর আগে স্বামী (ফজলুল হক) মারা যাওয়ার পর কিশোর ছেলেকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েন রাশিদা। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে নিজের কাঁধেই তুলে নেন সংগ্রামের চাকা।
তার আরেক বিধবা বড় বোন বানেছাকে (৭০) সঙ্গে নিয়ে এই বাজারে ১ হাজার টাকা পুঁজিতে শুরু করেন মুরগি ব্যবসা। ছেলেকেও পড়াশোনা করাচ্ছেন স্থানীয় একটি কলেজে।
এক সময় মা আছমা আক্তার ছিলেন এই বাজারের দোকানি। ব্যবসায়ী মাকে সহযোগী করেই বড় হয়েছেন খোদেজা বেগম (৩৫)। এরপর মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে হলেও ২ বছর আগে পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়ে যান স্বামী কাউসার মিয়া। মা মারা যাওয়ার পর কলোনিতে একটি ঘর মেলার পাশাপাশি ব্যবসায় এসে সংসারের হাল ধরেন খোদেজা।
খোদেজা বেগম বলেন, ‘স্বামী অসুস্থ্ হওয়ায় সন্তানদের নিয়ে খুবই বিপদে পড়ে যাই। এরপর মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে মাছ এনে এই বাজারে বিক্রি করি। এরপর মহাজনকে টাকা দেওয়ার পর দিনশেষে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা থাকে। এভাবেই এখন সংসার চলছে।
খোদেজার পাশেই মাছের দোকান চালান জাহান বেগম (৬৮)। টানাটানির সংসারে বাজার শুরুর সময়টাতে ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। বয়সের ভারে এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারেন না তিনি। তাই নাতিকে সঙ্গে নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা। তিনি বলেন, ‘মাছের দোকানের মাধ্যমে কয়েক হাজার টাকা প্রতিদিন আয় করি।’
বাজারের একটি কোনায় বিভিন্ন শুঁটকি বিক্রি করেন হালিমা আক্তার। ১১ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিলেন। এখন তার আয়ে সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালোভাবেই কাটছে তার সংসার। একসময় বাধা দেওয়া স্বামী জয়নাল মিয়াই এখন মালামাল কিনে এনে দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে তাকে ব্যবসায় সাহায্য করেন।
বাজার ঘুরে কিছু পুরুষ বিক্রেতাও চোখে পড়েছে। তবে তারা নিয়মিত কিংবা দোকানের কর্ণধার নন, হর্তাকর্তা নারীরাই। তাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, অসুস্থতা কিংবা অন্য কারণে কোনো নারী আসতে না পারলে স্বামী কিংবা সন্তানরা দোকানে এসে বেচাবিক্রি করে থাকেন।
চম্পা আক্তার নামে এক নারী বললেন, ‘আমরা মিলেমিশেই বাজারটিতে ব্যবসা করছি। এখানে সবাই কলোনির বাসিন্দা। পুরুষরাও মাঝেমধ্যে আমাদের সঙ্গে থেকে বেচাবিক্রি করে। বাজারের আয় থেকেই আমাদের সংসার চলে।’
এই বাজারের জনপ্রিয়তাও অনেক। প্রতিদিনই জমজমাট থাকা এ বাজারটিতে ক্রেতা হিসেবে পুরুষদের চেয়ে নারীদের সংখ্যাই দেখা যায় বেশি। এখানে নিয়মিত বাজার করতে আসেন নাজমা আক্তার। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘এই বাজারের সব দোকানিই নারী, তাই আমরা এখানেই আসি, বেশ সুবিধা পাই।’
রেবেকা সুলতানা নামে আরেক নারী ক্রেতা বলেন, ‘এই বাজারটি হওয়ায় নারীদের জন্য খুবই সুবিধা হয়েছে। এখানে বাজার করতে এসে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। নারী বিক্রেতা ও অনেক নারী ক্রেতা থাকায় এখানে এসে আমরা নিরাপদও বোধ করি।’
এমএসআর