মানবিক বিভাগে ভর্তি হওয়ায় বাবা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন

‘পুলিশ বাহিনীতে যখন যুক্ত হই, তখন থেকেই বাহিনীর সবাই আমরা পুলিশ। নারী পুলিশ অফিসার বলতে ফিজিক্যাল কোনো পার্থক্য দেখানোর সুযোগ নেই এখানে।’ কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি জেলার পুলিশ সুপার ফাতিহা ইয়াসমিন। একইভাবে নারীরা যখন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে সব কাজে এগিয়ে আসবেন এবং নিজেদের জীবনকে পুতুলখেলা ভাববেন না, তখনই ৮ মার্চ নারী দিবসের সার্থকতা আসবে বলে মত তার।
ফাতিহা ইয়াসমিনের বাংলাদেশ পুলিশে আসার সাহসী পদক্ষেপ, শিক্ষাজীবন ও শৈশব-কৈশোরের গল্পগুলো তুলে ধরা হয়েছে ঢাকা পোস্টে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অধিকাংশ মানুষেরই গ্রামীণ ও শহুরে দুটি জীবন। ফাতিহা ইয়াসমিনের গ্রামীণ জীবনের অনাবিল সৌন্দর্যে ভরা শৈশব যেকোনো বইয়ের গল্পকেও হার মানাতে পারে। আমগাছে উঠে ডালে বসেই আমটি খেয়ে আবার ডালের সঙ্গেই ঝুলিয়ে রেখে আসা, পেয়ারাগাছে উঠে পেয়ারা খাওয়া, বাড়ির পেছনের নদীতে সাঁতরে বেড়ানো, বাঁশের সাঁকো থেকে কচুরিপানায় লাফ দিয়ে ভরা মৌসুমে সাঁতরে তীরে ওঠা, চৈত্র মাসে ভাঙা প্লেট দিয়ে নদীর তীরে বালি উঠিয়ে সেই বালির মধ্যে থাকা মাছ মারা আর সেই মাছ আর ভাত রান্না করে বনভোজন করা— চমৎকার এসব দুরন্তপনার একটি শৈশব-কৈশোর পার করেছেন ফাতিহা ইয়াসমিন।
সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট হওয়ায় সবচেয়ে আদরের ছিলেন ফাতিহা। পড়াশোনায় প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত প্রথম স্থান ছাড়া দ্বিতীয় হননি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়াসহ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে তার উপজেলার মধ্যে সেরা ফলাফল অর্জন করেন। ১৯৯২ সালে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এত ভালো ফলাফল করলেও উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক বিভাগ বেছে নেন। এতে তার বাবা মনঃক্ষুণ্ন হন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন মেয়ে চিকিৎসক হোন। বাবা যখন দেখলেন উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে মেয়ে সর্বোচ্চ ৭৩২ পেয়েছেন, তখন মেয়েকে বলেছিলেন, আম্মু, তোমার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল।’
এরপর শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধ। ভর্তির জন্য প্রথম ২০০০ জনের তালিকা দেওয়া হলো। ফাতিহার বাবা নিচের দিকের ২০০০ নম্বর থেকে ৫০০-এর আগ পর্যন্ত সিরিয়ালে চোখ বোলালেন মেয়ে সিরিয়ালে আছে কি না। সেখানে না পেয়ে আশা ছেড়ে দিয়ে ৫০০ থেকে দেখা শুরু করেন। ৩৩৮ নম্বরে এসে মেয়েকে খুঁজে পান তিনি। ফাতিহা চেয়েছিলেন অর্থনীতি নিয়ে পড়তে। কিন্তু ৩১৫ পর্যন্ত ছিল অর্থনীতি। পরে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানেই স্নাতক সম্পন্ন করেন। নানা রকমের অভিজ্ঞতা আর আনন্দে পার করলেন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটি।
বরাবরই লক্ষ্য ছিল বিসিএস অফিসার হওয়ার। সে অনুযায়ী দীর্ঘ প্রস্তুতিও ছিল। ভর্তি হয়েছিলেন এমফিলেও। সবশেষ সেই স্বপ্ন এসে ধরা দেয় ২০০৫ সালে। বিসিএসে চেয়েছিলেন এমন একটি পেশা, যেখানে আলাদা করে বলতে হবে না তিনি কোন পেশায় কাজ করেন। তাই পুলিশ ক্যাডার বেছে নিলেন। ২৪তম বিসিএসে ২০৫ জন পুলিশের মধ্যে তিনি উত্তীর্ণ হন। যেখানে মাত্র ২০ জন নারীর মধ্যে একজন ছিলেন ফাতিহা।
রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে এক বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়েছে। ভোরে সূর্য ওঠার আগে প্রশিক্ষণ শুরু হতো। চলত রাত ৯টা পর্যন্ত। নারী-পুরুষের আলাদা ডরমিটরিতে তাদের সে সময়ের দিনগুলোও কেটেছে স্বপ্নের মতো।
প্রশিক্ষণ শেষে প্রভিশনাল পিরিয়ড হিসেবে প্রথম কর্মজীবন শুরু হয় মুন্সিগঞ্জে। পরে ২০০৬ সালে সিআইডিতে মালিবাগে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেখানেই ২০১২ সালে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি হয় তার। ২০১২-১৩ সালে লজিস্টিক অফিসার হিসেবে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে হাইতিতে যান। সেখান থেকে ফিরে ২০১৩ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটনে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন অর্থাৎ ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে যোগ দেন।
আবারও জাতিসংঘ শান্তি মিশনে কঙ্গোতে যান ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে। সেখান থেকে ২০১৬ সালে ফিরে ডিএমপিতে যুক্ত হন। ২০১৭ সালে পুলিশ সুপার হিসেবে পদোন্নতি হওয়ার চার মাস পরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে ডিসি ট্রাফিক বন্দর হিসেবে দায়িত্ব নেন। এসপি ফাতিহা ইয়াসমিনের ভাষ্য অনুযায়ী, সেখানে ১ বছর ৪ মাস সময় অত্যন্ত বিচিত্র ও মধুর সব ঘটনার মধ্য দিয়ে পার করেছেন।
২০১৯ সালের ২০ জুন ঝালকাঠিতে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। জেলায় আসার পর মানবিক পুলিশিং, বিট পুলিশিং সেবা এগিয়ে নিচ্ছেন অনন্য ভূমিকায়। প্রচারবিমুখ এই অফিসার তার বাবার পথ অনুসরণ করে মানুষকে আর্থিক সাহায্য করে যাচ্ছেন অতি গোপনে। সম্প্রতি নিজের শিশুসন্তানের কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আরেকজন শিশুর চোখ অপারেশনের ব্যবস্থা করেন। পরের দিনই একজন মেধাবীকে সাহায্য করেন। তিনি জানান, তার বাবা মানুষকে যেভাবে সাহায্য করতেন, সেই তুলনায় এসব কিছুই না। কাউকে ডান হাতে সাহায্য করলে বাঁ হাত যেন খবর না জানে, সেই পদ্ধতিতে তিনি এগিয়ে যেতে চাইলেও কীভাবে যেন মিডিয়া জেনে যায় বলে জানান তিনি।
ঝালকাঠির যেসব জায়গায় মাদকাসক্তদের অবাধে আড্ডা চলত, তা তিনি বন্ধ করেছেন। সন্ধ্যার পর শিশু-কিশোরদের বাইরে আড্ডা দেখে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। যখন জানতে পেরেছেন ছেলেমেয়েরা বাসায় বলে এসেছে পড়তে যাওয়ার কথা কিন্তু তা করেনি, তখন মা-বাবা ও তাদের সন্তানদের মধ্যে দূরত্ব কমানোর জন্য কাউন্সেলিংয়ের সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরে থানায় ২০ থেকে ২৫ জন অভিভাবক ও সন্তানকে ডেকে শুরু করেন কাউন্সেলিংয়ের প্রথম সপ্তাহ। এরপর থেকে শিশু-কিশোরদের কাছে হয়ে গেলেন পুলিশ খালামণি। ছেলেমেয়েদের মধ্যেও ভয় যে সন্ধ্যায় পড়া রেখে শহরে আড্ডা দিলে খালামণির বাহিনীরা ধরে আনবে খালামণির কাছে। ফাতিহা ইয়াসমিনের মতে, এসব কারণে এই জেলায় কিশোর গ্যাংয়ের মতো কোনো ঘটনা নেই।
এসপি ফাতিহা বলেন, মানুষ যেকোনো সমস্যা নিয়েই আমাদের কাছে আসে। আমার আওতার বাইরে হলেও সংশ্লিষ্ট দফতর বা জায়গাগুলোয় যোগাযোগ করে সমস্যার সমাধান করে দেওয়ার চেষ্টা করি।
নারী দিবস উপলক্ষে এই এসপি বলেন, নারীরা সবাই যেন নিজেদের অন্যভাবে ভাবতে শুরু করেন। শুধু স্টার জলসা দেখা আর হাঁড়ি-পাতিলের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে না নেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডাকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অগ্রগতিতে নারীদের ভূমিকা রাখতে হবে।
এনএ