উন্নয়ন আর প্রতিশ্রুতির হিসাব মেলাচ্ছেন ভোটাররা

আর দু’দিন পর ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন (রসিক) নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণায় জমে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। ব্যস্ত সময় পার করছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। ভোটের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষছেন সাধারণ ভোটাররা। বিগত দিনের উন্নয়নের মূল্যায়ন আর নিত্য-নতুন প্রতিশ্রুতির হিসাব মেলাতে সচেতন ভোটাররাও ব্যস্ত।
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রংপুর সিটি কর্পোরেশনে ২৭ ডিসেম্বর তৃতীয়বারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টি ওয়ার্ড বর্ধিত এলাকা। আয়তনে বিশাল এই নগর বিগত ১০ বছরের উন্নয়নে কিছুটা বদলে গেছে। উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, কমেছে দূরত্ব। মূল শহরের ভাঙাচোরা সড়কগুলো এখন পুরোপুরি চলাচল উপযোগী। অলিগলি থেকে শুরু করে মূল সড়কের পাশে নালা নির্মাণ হয়েছে। উন্নত হয়েছে বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনার। তবে শ্যমাসুন্দরী খাল হয়নি অভিশাপমুক্ত। কমেনি যানজটের ভোগান্তি।
এবার নির্বাচনে মেয়র পদে ৯ প্রার্থীর মধ্যে চারজন নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও ঢাকঢোল পিটিয়ে ভোটারদের কাছ টানতে দিচ্ছেন নানান প্রতিশ্রুতি। কেউ কেউ আবার ইশতেহারও দিয়েছেন। প্রার্থীদের নিত্য-নতুন প্রতিশ্রুতি আর ইশতেহারের সঙ্গে বিগত সময়ের দৃশ্যমান উন্নয়নের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছেন সাধারণ ভোটাররা। এতে কেউ সন্তুষ্টির ঢেকুর তুলছেন আবার কেউ অখুশি প্রত্যাশার পারদে অপূর্ণতা থাকায়।

সরেজমিনে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, এখনো বর্ধিত এলাকাগুলোর রাস্তা কাঁচা রয়েছে। মূল সড়কগুলো পিচঢালা হলেও অলিগলিতে লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। নালা নির্মাণ হয়নি, নেই বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থা, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সড়কবাতির খুঁটি বসলেও কোথাও আলো পৌঁছেছে আবার কোথাও আলোহীন খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে।
বর্ধিত এলাকাগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন হয়েছে, বেশিরভাগ গ্রামীণ জনপদ হওয়ায় এখনো মূল শহরের বাসিন্দাদের মতো জীবনমানের উন্নয়ন হয়নি। এদিক থেকে উন্নয়ন ও সেবাপ্রাপ্তির সুবিধায় অনেক বেশি এগিয়ে মূল শহরের বাসিন্দরা।
উন্নয়ন ও অভিব্যক্তি :
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজন যেন এখনো পাড়াগাঁয়ের বাসিন্দা। রণচণ্ডী, মনোহর, উত্তম, গঙ্গাহরি, মন্থনা ও হরিরাম এলাকা নিয়ে ১ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। এই ওয়ার্ডের হরিরাম এলাকার বাসিন্দা কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, ৫ বছর আগোত হামরা যেমন আছনো, এ্যলাও তেমনই আছি বাহে। সিটিত আসিয়া হামার তেমন লাভ হয় নাই। নতুন নতুন কিছু বাড়ি হইলেও রাস্তাঘাট এ্যলাও কাঁচা আছে।
রংপুর সিটির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডটি জেলার সবচেয়ে পুরোনো এলাকা। বর্ধিত এলাকার এই ওয়ার্ডের মাহিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী পলাশ কান্তি নাগ। সেইসঙ্গে মহানগর নাগরিক কমিটির সদস্যও তিনি। তরুণ এই আইনজীবী বলেন, প্রধান সড়কে নালা নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার বাসাবাড়ির পানি কোথায় যাবে? এজন্য ছোট ছোট সড়কে কোনো নালা নির্মাণ করা হয়নি। ফলে পানি নিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এছাড়া পাইপ লাইনের মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশনের সরবরাহ করা পানি মিললেও সেটা কখনো আসে, আবার কখনো আসে না। এলাকার বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালটিও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।

দেওয়ানটুনি, ফতেপুর, বড় রংপুর, আফানউল্লাহ, কাপরিয়া রোড, জেবিসেন রোড, মাহিগঞ্জ রোড, রথবাড়ি, কুচবিহার রোড, তাজহাট চকবাজার, কানুনগো টোলা, ধুমখাটিয়া, খোর্দ রংপুর, বসাইবাড়ি, কসাইটুলি, কলাবাড়ি, গোদাসিমলা নিয়ে ২৯ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। সরেজমিনে এই ওয়ার্ডে দেখা গেছে, অলিগলিতে নালা নেই। তবে প্রধান সড়কের পাশে নালা নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কগুলোও পাকা হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় সড়কবাতি অপ্রতুল। তবে নতুন ভবন খুব একটা চোখে না পড়লেও প্লট আকারে জমি বিক্রির প্রবণতা বেড়েছে। এতে বেড়েছে জমির দাম।
২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মুক্তার হোসেন বলেন, আমি এলাকার উন্নয়নে যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। রাস্তা পাকা করেছি। সড়কবাতিও লাগানো হয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ কম থাকায় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী উন্নয়ন করতে পারিনি। পুনরায় নির্বাচিত হলে বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা করব।
পশ্চিম খাসবাস, জিএল রায় রোড, বীর ভদ্র, নাচনিয়া, কাচু, পূর্ব খাসবাগ, বোতলা, দখিগঞ্জ, কুটিরপাড়া এলাকা নিয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। স্থানীয়রা জানান, এ এলাকায় নতুন একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যার নির্মাণকাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এলাকার পরিবেশ এখনো গ্রামীণ। তবে সড়কগুলো পাকা হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় নালা নির্মাণ না হওয়ায় পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
সিটির ১০ নম্বর ওয়ার্ডের জগদীশপুর গ্রামের বাসিন্দা মানিক চন্দ্র। তিনি স্থানীয় ডুগডুগির বাজারে ব্যবসা করেন। মানিক চন্দ্র বলেন, সিটি কর্পোরেশন হওয়ার ১০ বছর হয়েছে। আজও নালা নির্মাণ হয়নি। বাসাবাড়ির পানি শুকনো মৌসুমে আশপাশের জমিতে চলে যায়। কিন্তু বর্ষাকালে এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। পানি সরে যাওয়ার উপায় থাকে না। আবাদি জমির ফসল নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়।

সিটির ১০, ১১ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডও এই বর্ধিত এলাকার মধ্যে পড়েছে। জগদিশপুর, বক্তারপুর, পশ্চিম ও পূর্ব গিলাবাড়ি, রথিরামপুর এলাকা নিয়ে ১০ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের অধিকাংশ সড়ক পাকা হয়েছে। চলাচলের অসুবিধা নেই। কিন্তু পয়নিষ্কাশন নালা ও বর্জ্য অপসারণ ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। পুরো এলাকার পরিবেশ গ্রামীণ। চারদিকে শুধু আবাদি জমি।
বর্ধিত এলাকার ১২ নম্বর ওয়ার্ডের রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী এনামুল হক বলেন, আগের থেকে এলাকার অবস্থা ভালো হয়েছে। সড়ক পাকা হয়েছে। খুব সহজে এখন অটোরিকশায় চড়ে মূল শহরে যাওয়া-আসা করা যায়। তবে এখনো এই ওয়ার্ডে কোনো নালা-নর্দমা নির্মাণ করা হয়নি।
এই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর রবিউল আবেদীন জানান, চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তিনি এলাকায় নালার কাজ করতে পারেননি। তবে রাস্তাগুলো পাকা করে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করেছেন। উন্নয়নের জন্য ৫ বছর সময়টা খুব একটা বেশি নয়। পুনরায় নির্বাচিত হলে বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করবেন।
আমাশু, কুকরুল, কাইমাগিলি, বিনোদ, বালাকুমার, নীলকণ্ঠ, ভগি, ধাপ এলাকা নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর ওয়ার্ড। অন্য ওয়ার্ড থেকে এই ওয়ার্ডের সড়কগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো। দীর্ঘ বছরেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়নি। আমাশু এলাকার বাসিন্দা এম এন নজু বলেন, আমাদের এলাকার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আগের চেয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এখন মানুষের জন্য সেবাপ্রাপ্তিতে ভোগান্তি কমেছে। এলাকায় বাজার বসছে। ঘর থেকে বের হলেই কেনাকাটা করতে পাওয়া যায়। জরুরি ওষুধও মেলে। যেটি আগে ছিল না। তবে সড়কবাতি অপর্যাপ্ত।
এই ওয়ার্ডের কুকরুল এলাকার বাসিন্দা শওকত আলী বলেন, আগে তো আমরা ইউনিয়নের বাসিন্দা ছিলাম। তখন আয়কর ছিল না। এখন আমরা সিটির বাসিন্দা। বর্তমান মেয়র আয়কর না নিলেও ভবিষ্যতে তো সবাইকে দিতেই হবে। গত এক দশকে এলাকার মূল সড়কের উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু অলিগলির রাস্তাগুলো এখনো কাঁচা রয়েছে। অবস্থাটা এমন যে, উপরে খুব চকচকা কিন্তু ভেতরে কিছুই নেই। আমাদের উন্নয়ন দরকার।

সিটির গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড ২১ নম্বর। এটি মূল শহরের অন্যতম একটি ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে শ্যামাসুন্দরী খাল। এই খালের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে নাকে দুর্গন্ধ আসে। খালের জায়গায় জায়গায় আবর্জনার স্তূপ। সেখানে ভনভন করে উড়ছে মশা-মাছি। যেন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত শ্যামাসুন্দরী মশা-মাছির প্রজনন কেন্দ্র।
এই ওয়ার্ডের সেনপাড়া এলাকার বাসিন্দা মেজবাহুল হিমেল বলেন, এই খাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না থাকায় মশার উৎপাতে আমরা অতিষ্ঠ। সেইসঙ্গে এলাকায় খেলার মাঠও হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে রাস্তা ও নালার কাজ হয়েছে। এলাকার অলিগলির রাস্তাগুলো অপ্রশস্ত হওয়ায় গাড়ি নিয়ে চলাচল করা কষ্টকর।
নগরের নিউ সেনপাড়া, সেনপাড়া, করণজাই রোড, নিউ আদর্শপাড়া, শাপলা চত্বর হাজীপাড়া, মুচিপট্টি, চামড়াপট্টি, কলেজ রোড আলমনগর, আকালিটারী (হাবিবনগর) এলাকা নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা সদ্য সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। নগরের গুরুত্বপূর্ণ এই ওয়ার্ডটি অন্যান্য ওয়ার্ডের তুলনায় উন্নত হলেও শ্যামাসুন্দরী খালের ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো এখনো পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। করণজাই রোডে একটি সেতুর কাজ শুরু হলেও দুই বছরের বেশি সময় ধরে সেতুর কাজ অসম্পন্ন অবস্থায় রয়েছে।
নগরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কলেজ রোড খামার এলাকার বাসিন্দা হাসান আরেফিন বলেন, নির্বাচন শুরুর পর থেকে কাউন্সিলর ও মেয়র প্রার্থীদের অনেক প্রতিশ্রুতির কথা শুনছি। কিন্তু ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তো আগের কাজগুলো আমরা বিশ্লেষণ করে দেখব। তারপর যে প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ সর্বজন গ্রহণযোগ্য হবে, যিনি নগরীর সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন এমন প্রার্থীকেই বেছে নেব।
নগরের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের মুলাটোল আমতলা মোড় এলাকার ওসমান গণি বলেন, আমরা আগামীতে রংপুর সিটিতে যানজট দেখতে চাই না। সামান্য বৃষ্টি হলে শ্যামাসুন্দরী খাল উপচে জলাবদ্ধতায় নিমজ্জিত হতে চাই না। আমরা একটা পরিকল্পিত উন্নয়ন দেখতে চাই। প্রার্থীরা তো অনেকেই অনেক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু বিগত সময়ের কাজের ফিরিস্তি ঘেটে দেখলে তাদের সবার মধ্যেই কথা-কাজে অমিল রয়েছে। এ কারণে শুধু প্রতিশ্রুতি বা ইশতেহার শুনে নয়, যে ব্যক্তি কথার চেয়ে কাজে বেশি পারদর্শী বলে মনে হবে আমি তাকেই ভোট দেওয়ার পক্ষে।
মেয়র প্রার্থীদের নির্বাচনী ইশতেহার :
এদিকে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা ছুটছেন ভোটারদের দ্বারে দ্বারে। গণসংযোগ ও পথসভায় দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। রংপুর মহানগরের পরিকল্পিত উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসন, বেকারত্ব দূরীকরণ, যানজট সমস্যা থেকে উত্তরণ ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাসহ নানা পরিকল্পনার কথা জানিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া।
প্রস্তাবিত ২৯ দফা ইশতেহারে সাবেক সংসদ সদস্য হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া বলেন, শ্যামাসুন্দরী খালের দুপাশে মাটি ভরাট করে উঁচু করে একমুখী রাস্তা তৈরির মাধ্যমে রিকশা ও অটোরিকশা চলাচলের ব্যবস্থা করবো। স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকা স্কুল-কলেজের উন্নয়ন, নারীদের জন্য কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বেকারত্ব ঘোচানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত হলেও বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোতে গত ১০ বছরে কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বিস্তৃত এলাকার বাসিন্দারা রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ নানা সেবা থেকেই বঞ্চিত। আমি বর্ধিত ওয়ার্ডের জনগণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে মেগা প্রকল্প নিয়ে আসব।
তিনি আরও বলেন, ভোট চাইতে গিয়ে আমি বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা দেখেছি। সিটি কর্পোরেশন হয়েও বর্ধিত ওয়ার্ডের জনগণের কোনো উন্নয়ন হয়নি। তাই আমি নির্বাচিত হলে রংপুর সিটির পরিকল্পিত উন্নয়নের পাশাপাশি বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোর জন্য মেগা প্রকল্প নিয়ে এসে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন থেকে শুরু করে সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করব।
অন্যদিকে রংপুর সিটি কর্পোরেশনকে (রসিক) একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত গ্রিন সিটি হিসেবে গড়তে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করার ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা।
তার প্রস্তাবিত ৩১ দফার ইশতেহারে নগরীর সৌন্দর্য রক্ষার্থে শ্যামাসুন্দরী খালকে পুনরুজ্জীবিত করা, উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, যানজট নিরসনসহ ২৫০ বছরের পুরাতন এই শহরকে স্মার্ট সিটিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রস্তুতকৃত মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
সদ্য সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত পাঁচ বছরে ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরাতন ১৫টি ওয়ার্ড ছাড়া বর্ধিত ১৮টি ওয়ার্ড থেকে একটি টাকাও কর আদায় করিনি। ২০১৭ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি। আমি বলেছিলাম শতভাগ সেবা নিশ্চিতের আগে কর আরোপ করা হবে না। আমি সেই কথা রেখেছি, কর আরোপ না করেই বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোতে উন্নয়ন করেছি। জনগণ তার সুফল পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বর্ধিত ওয়ার্ডগুলোতে এ পর্যন্ত ৭৫ ভাগ উন্নয়ন হয়েছে, আরও ২৫ ভাগ বাকি। এই ২৫ ভাগ যখন সম্পন্ন করতে পারব, তখন মূল শহরের তুলনায় বর্ধিত এলাকাগুলোতে পার্থক্য কমে আসবে। বর্ধিত এলাকাগুলোতে প্রায় ১২৪০ কিলোমিটার রাস্তার কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি রয়েছে ৬৫০ কিলোমিটার। যদি আবার নির্বাচিত হতে পারি, বর্ধিত এলাকাগুলোর উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি :
সম্প্রতি সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে মেয়র প্রার্থীরা জনগণের মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সঙ্গে নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। এ সময় তারা ১০ লাখ লোকের বসবাসের রংপুর সিটি কর্পোরেশন এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসন, যানজটমুক্ত, খেলাধুলার মাঠ সংরক্ষণ, পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, প্রশস্ত ও বিকল্প সড়ক নির্মাণ, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, হাইটেক পার্কের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নাগরিক সেবা সহজীকরণসহ একটি পরিকল্পিত, আধুনিক ও বাসযোগ্য মডেল নগরী গড়ার অঙ্গীকার করেন।
প্রার্থীরা আরও বলেন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় রংপুর সিটি কর্পোরেশন। এখনই সময় এই সিটিকে বাংলাদেশের সকল সিটি থেকে সমৃদ্ধ ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার। গেল এক দশকে উন্নয়ন হয়েছে, তবে জনগণের প্রত্যাশিত উন্নয়ন এখনো হয়নি। বিশেষ করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সিটির বর্ধিত এলাকাগুলোর সম-উন্নয়ন নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিকল্পনার আলোকে কাজ করতে হবে, যাতে আগামী প্রজন্মের জন্য রংপুর সিটি একটি বসবাসের উন্নত নগরীতে পরিণত হয়।
এবার রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া, জাতীয় পার্টির মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-ইনু) শফিয়ার রহমান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমিরুজ্জামান পিয়াল, খেলাফত মজলিশের তৌহিদুর রহমান মণ্ডল রাজু, জাকের পার্টির খোরশেদ আলম খোকন, বাংলাদেশ কংগ্রেসের আবু রায়হান, স্বতন্ত্র প্রার্থী লতিফুর রহমান মিলন ও মেহেদী হাসান বনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ইভিএমে ভোট, বেড়েছে ভোটার :
আগামী ২৭ ডিসেম্বর রংপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এতে ২ লাখ ১২ হাজার ৩০২ জন পুরুষ এবং ২ লাখ ১৪ হাজার ১৬৭ জন নারী ভোটার ২২৯টি কেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। এবার মেয়র পদে ৯ জনসহ সংরক্ষিত ১১টি ওয়ার্ডে ৬৮ এবং ৩৩টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১৮৩ জন কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর এ সিটিতে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল। এতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ১ লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু পান ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা পেয়েছিলেন ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট।
এবার ভোটার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২৬ হাজার ৪৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১২ হাজার ৩০২ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ১৪ হাজার ১৬৭ জন। ২০১৭ সালে ভোটার সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৯৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৫৬ ও নারী ১ লাখ ৯৭ হাজার ৬৩৮ জন। এবার নতুন ভোটার বেড়েছে ৩২ হাজার ৪৭৫ জন।
এসপি