পাঠ্যবইয়ে ঝিনাইদহের হরিপদ কাপালী ও চেয়ারম্যান ঋতুর গল্প 

Dhaka Post Desk

জেলা প্রতিনিধি, ঝিনাইদহ

১১ জানুয়ারি ২০২৩, ০৪:০২ এএম


পাঠ্যবইয়ে ঝিনাইদহের হরিপদ কাপালী ও চেয়ারম্যান ঋতুর গল্প 

নতুন বছরের শুরুতেই সারাদেশের স্কুলশিক্ষার্থীরা হাতে পেয়েছে নতুন বই। নতুন বইতে ছাপা হয়েছে ঝিনাইদহের কৃষি বিজ্ঞানী হরিপদ কাপালী এবং তৃতীয় লিঙ্গের ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতুর গল্প। হরিধানের উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী বইতে স্থান পেয়েছেন ৪ ও ৫ নং পৃষ্ঠায়। বিজ্ঞান বইতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অধ্যায়ে দুইজন বিজ্ঞানীর কথা বলা হয়েছে। একজন স্যার আইজ্যাক নিউটন, অন্যজন ঝিনাইদহের গর্ব হরিপদ কাপালী। 

আবার নতুন সংস্করণের সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ছাপা হয়েছে তৃতীয় লিঙ্গের ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ঋতুর জীবনের গল্প-ছবি। ছবিটি বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ের ‘সম্প্রদায়’ এর ৫২ নম্বর পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। 

নজরুল ইসলাম ঋতু ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে ৫ হাজার ২৮ ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে চেয়ারম্যান হন তিনি। সারাদেশের মধ্যে তিনিই একমাত্র তৃতীয় লিঙ্গের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাই ঋতুর জীবন সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প এখন বইয়ের পাতায়।

হরিপদ কাপালী

একজন সাধারণ মানুষের যদি বৈজ্ঞানিক মন থাকে তাহলে তিনিও বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারেন। বিজ্ঞান মনস্ক হরিপদ কাপালী তারই উদাহরণ। এ কারণেই তিনি নিরক্ষর কৃষক হয়েও ধান আবিষ্কারে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম তার। জন্মের ৭-৮ বছর পর তার বাবা কুঞ্জু লাল বিশ্বাস ও মা সরোধনীকে হারান। যুবক বয়সে বিয়ে করে ঘরজামাই থাকেন। বিবাহিত জীবনে নিঃসন্তান হওয়ায় ভায়রার ছেলে রুপকুমারকে নিজের ছেলে হিসাবে লালন পালন করেন। ২০১৭ সালে ঝিনাইদহের সাধুহাটি ইউনিয়নের আসাননগরে নিজ বাড়িতে মারা যান হরিপদ কাপালী। চুয়াডাঙ্গার আলীয়ারপুর শ্মশানে তার দাহ সম্পন্ন হয়। 

dhakapost

স্থানীয় সাংবাদিক গিয়াস উদ্দীন সেতু ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন বইতে হরিপদ কাপালীর পরিচয় সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি। হরিপদ কাপালীকে নিয়ে দেশ-বিদেশের অনেক মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হয়েছে। তাতে অনেক তথ্যগত ত্রুটি থাকলেও ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বইতে হরিপদর পরিচয় দেওয়া হয়েছে তিনি যশোর এলাকার একজন সাধারণ চাষি। অথচ তিনি ঝিনাইদহ জেলার একজন গর্বিত সন্তান। এই পূর্ণাঙ্গ পরিচয়টা নতুন প্রজন্মকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বা সম্পাদনা পরিষদ দিতে কার্পণ্য করেছে। আশা করি হরিপদ কাপালীর গ্রাম, জেলা ও উপজেলার পরিচয়টি আগামী সংস্করণে সম্পাদনা পরিষদ ভুল করবে না।

হরিপদ কাপালীর স্ত্রী সুনিতী কাপালী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হরিপদ রাস্তার পাশে ধান লাগিয়েছিলেন। সেই ধানের জমি পরিচর্চা করার জন্য জমিতে গিয়ে দেখতে পান কিছু আলাদা জাতের ধান। যে ধানগুলো সাধারণ ধানের চেয়ে আলাদা। ধানের গাছগুলোও বড় বড় আবার ধানের শীষগুলোও অনেক বড়। এরপর কাচের বোতলে করে ওই ধান তিনি সংগ্রহ করেন। নতুন করে ধানের চারা দেন এবং হাফ কাঠা জমিতে ধানটা লাগান। সেই ধানের বাম্পার ফলনের ফলে আস্তে আস্তে তার পরিচিতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধানের বাম্পার ফলন দেখে স্থাণীয় সাংবাদিক গিয়াস উদ্দীন সেতু তাকে নিয়ে নিউজ করেন। তার ওই নিউজের পর থেকেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং টেলিভিশনে তাকে নিয়ে নিউজ হয়। সেই থেকেই তার নামের সঙ্গে মিল রেখে ধানের নাম হয় হরিধান।

তিনি আরও বলেন, স্কুলের ছেলে-মেয়েরা হরিপদকে নিয়ে ছাপা যে বই পড়বে, সেই বই আমিও পড়েছি। পড়ে আমার খুব ভালো লেগেছে। তবে বইতে যে পরিচয় ভুল করেছে সেটা সঠিক করে দিলে ভালো হয়। আমাদের কোনো ছেলে-মেয়ে নেই, আমরা নিঃসন্তান, রুপকুমার আমাদের পালিত ছেলে।

হরিপদ কাপালীর পালিত ছেলের স্ত্রী শুসমা কাপালী ঢাকা পোস্টকে জানান, শ্বশুরকে নিয়ে এখন বই ছাপা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে আপনারা কী হরিপদ কাপালীকে চেনেন। সেই বই সারাদেশের শিক্ষার্থীরা পড়ছে। এটা আসলেই অনেক ভালো লাগার বিষয়। তিনি কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সবাই জানছে হরিপদ কাপালী নামে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। 

১নং সাধুহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী নাজির উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে জানান, হরিপদ কাপালীর উদ্ভাবনী শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তায় একটি নতুন জাতের ধান পেয়েছি আমরা। তার নামে ধানটা আবিষ্কার করেছিলেন। বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকরা ধানের বীজ নিয়ে চাষ করে সফলতা পেয়েছিলেন। যার ফলে কৃষি বিভাগের সহযোগীতায় তিনি আজ এই কৃষি বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তবে পাঠ্য বইতে তকে নিয়ে যে লেখা হয়েছে, সেখানে তার পূর্ণাঙ্গ পরিচয়টা তুলে ধরা হয়নি। এটি সংশোধন করা জরুরি। 

তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু

তৃতীয় লিঙ্গের হয়েও নজরুল ইসলাম ঋতু সামাজ জীবনে এবং পেশাগত জীবনে সংগ্রাম করে সাফল্য পেয়েছেন । হয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চেয়ারম্যান। তাই নতুন সংস্করণের সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা বোর্ডের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ছাপা হয়েছে তার গল্প এবং ছবি।  

জানা যায়, নজরুল ইসলাম ঋতু ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। দেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আছেন আরও কয়েক হাজার হাজার। কতজনের কথাই বা জানে দেশের মানুষ। কিন্তু ঋতুর কথা দেশের বেশির ভাগ মানুষ জানবে। তার জীবনের সংগ্রাম-সাফল্যের গল্প পড়ে বড় হবে শিশুরা। পাঠ্যবইয়ে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নানা দিক তুলে ধরা হয়েছে। 

dhakapost

বলা হয়েছে- জন্মের পর খুব অল্প বয়সে বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের ছেড়ে গুরুমার কাছে চলে যেতে হয় তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের। সেখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে একটি পরিবারের মতো বসবাস করে। তারা শিশু আর নতুন বর-বউকে আশীর্বাদ করে টাকা উপার্জন করে। স্বাভাবিক মানুষের মতো লেখাপড়া ও চাকরি করতে চাইলেও অন্যরা তাদের সমাজে নিতে চায় না। অন্য দেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। তবে ২০১৩ সালে সরকার তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজে নিচ্ছে। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, নজরুল ইসলাম ঋতু ঝিনাইদহের কালিগঞ্জে উপজেলার ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাদপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কাদেরের সন্তান। তার আরও তিন ভাই ও তিন বোন রয়েছে। তিন ভাই ঢাকায় থাকেন ও বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে।

পাঠ্যবইয়ে ছবি ছাপা হওয়ার বিষয়ে নজরুল ইসলাম ঋতু ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা আমার কাছে অনেক বড় সুখবর এবং ভাগ্যের। আমার জন্য অনেক ভালো হয়েছে। এই অনুপ্রেরণা আগামীতে আরও ভালো কাজ করতে উৎসাহ যোগাবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে কর্মজীবনে সফলতা পাওয়া তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের কথা তুলে ধরা হয়েছে নতুন পাঠ্যবইয়ে। এতে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অবদান সম্পর্কে জানবে। 

ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক মনিরা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঝিনাইদহের হরিপদ কাপালীকে হরিধানের উদ্ভাবক বা বিজ্ঞানী হিসেবে এবং তৃতীয় লিঙ্গের হয়েও সমাজে অবদান রাখায় নরুজল ইসলাম ঋতুকে নিয়ে পাঠ্যপুস্তুকে গল্প ছাপা হয়েছে। এটা আসলেই অনেক গর্বের। তৃতীয় লিঙ্গের যে চেয়ারম্যান আছেন তিনি নিজেও আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন এবং সমাজে অনেক ভালো কাজ করেন। তাদের নাম পাঠ্যপুস্তুকে আসায় আমি অনেক আনন্দিত। 

আব্দুল্লাহ আল মামুন/আরএআর

Link copied