আতঙ্কে পুরুষশূন্য কাবিলপুর চর

একটি হত্যা মামলাকে কেন্দ্র করে গ্রেফতার এড়াতে গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাবিল চর পূরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এতে এক মাস ধরে মসজিদসহ একমাত্র বাজারটি বন্ধ হয়ে জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। এই চরের নারীরা দিনে বাড়িতে থাকলেও রাতযাপন করছেন ভুট্টাখেত ও কলাবাগানে। তবে পুরুষরা গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে থাকলেও নারীরা রয়েছেন ইজ্জতহানির ভয়ে। মামলার বাদীরা প্রভাবশালী ও অর্থবিত্তের মালিক হয়ে এই চরে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
উপজেলার চর কাবিলপুরের একমাত্র বাজারটি এক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। একটি দোকানও খোলা রাখা হয়নি। এমনকি বাজারের পাশের মসজিদটিতে আজান পর্যন্ত হয়নি এই এক মাস। এই চরে অবস্থিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একমাত্র বিদ্যাপিঠ আনন্দলোক স্কুলটিতেও হচ্ছে না কোনো ক্লাস। শিক্ষার্থীরা ভয়ে বেরোচ্ছে না রাস্তায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, হত্যার বদলা নিতে নিহত লাল মিয়ার ১১ জন ছেলে চর কাবিলপুরে প্রভাব খাটিয়ে সব দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। স্কুলে ক্লাস করতে দিচ্ছেন না তারা। এমনকি মসজিদে যে আজান দেবে, তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সেই সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবারের বাড়িঘর ভাঙচুর, ধান-চাল, নগদ টাকা, আসবাব লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে ১১ ভাইয়ের বিরুদ্ধে। এসব পরিবারের ঘরে গত এক মাসে জ্বলেনি চুলা। পুরুষরা ঘরছাড়া আর নারীরা রয়েছেন সম্মানহানির আতঙ্কে। নারীরা দিনে বাড়িতে থাকলেও রাত যাপন করছেন ভুট্টাখেত আর কলাবাগানে।
এদিকে ১ মার্চ কাবিলপুর চরের মিজানুর ও আনিচের বাড়িঘরে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। তবে প্রতিবেশী আনোয়ারা বলছেন, ঘরে আগুন জ্বালিয়ে অন্যান্য ঘর থেকে সব লুটে নিয়েছে ওই ১১ ভাই। তিনি আরও বলেন, আতত ভুটার জমিন থাকি দেখম নাল মিয়ার বেটারা ঘরত আগুন দিলি। হেরপর তারা অন্য ঘরত ঢুকি সব ভাঙ্গিল। সাথে বহুকিছু নিচে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য এনায়েত আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়ির শোয়ার ঘরের সব আসবাব মাটিতে ভাঙচুর করা হয়েছে। বিছানাপত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র মেঝেতে এলোমেলো পড়ে রয়েছে। গোলাভরা ধান-চালসহ কিছুই অবশিষ্ট নেই। একই চিত্র বাকি আরেকটি ঘরেরও।
এ নিয়ে এনায়েত আলীর স্ত্রী রেজিয়া বেগম বলেন, গরু-বাছুর, ধান-চাল, টাকাপয়সা যা আছিল, কিচ্ছু নাই। এই ছেঁড়া কাপড়টা ফেলা থুয়ে গেছে তাই পিনদিছি। ওরা সন্ত্রাস আগের থেইকায়। ওগোর ব্যবসায়ই ওইডা।
স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, চর কাবিলপুর ছাড়াও পার্শ্ববর্তী চরে জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে ফুলছড়ি থানায় নিহত লাল মিয়া ও তার ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে তিনটি। মামলায় দিনদুপুরে অস্ত্র উঁচিয়ে নারীদের জিম্মি করে সর্বস্ব লুট ও ইজ্জত হননের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয়রা জানান, ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের তেলকুপি গ্রামের লাল মিয়া নিহত হওয়ার জেরে তার ১১ ছেলে চর কাবিলপুরে প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই চরের অর্ধশতাধিক বাড়িঘর লুটপাট, ভাঙচুর ও গবাদিপশু লুট করেছেন নিহত লাল মিয়ার ছেলেরা। এ কারণে চরের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
উল্লেখ্য, গত ৯ ফেব্রুয়ারি দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন তেলকুপি গ্রামের লাল মিয়া। এ ঘটনায় পরদিন ফুলছড়ি থানায় করা হয় হত্যা মামলা। সেখানে ২৬ জন নামীয়সহ অজ্ঞাতনামা আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫ মার্চ একই চরের ২৭ জনের বিরুদ্ধে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাটের মামলা করেন নিহত লাল মিয়ার ছেলে মুরশিদ আলী। একই দিন লাল মিয়ার বিয়াই আবুল বাশার চৌধুরী তার ছেলের বউকে মারপিটের অভিযোগ এনে ফুলছড়ি থানায় একই পরিবারের পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
তবে ১০ ফেব্রুয়ারি হত্যা মামলার পর থেকে চর কাবিলপুর গ্রামে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। স্কুল-বাজার কিংবা মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে যেতে পারছেন না কেউই। বাড়িঘর লুট হওয়া এই চরের তৈয়বুরের স্ত্রী এলিজা বেগম বলেন, সব শেষ বাবা। ডাকাত লাল মিয়ার বেটারা হামার সব নিচে। রামদা নিয়ে কোপাতে আসে। মসজিদে নামাজ পড়তে দেয় না। বাজারের দোকান খুলতে দেয় না।
স্থানীয় আনন্দলোক স্কুলের দলনেতা হাজেরা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, চরে শান্তি ফিরিয়ে দেওয়া হোক। লুটপাট করা মালামাল ফেরত চাই আমরা। আমরা রাতে বাচ্চা নিয়ে থাকতে পারি না। স্কুল খুলতে দেয় না। তারা ডাকাত। তাদের বিচার হয় না।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নিহত লাল মিয়ার ছেলে হত্যা মামলার বাদী মুরশিদ আলী বলেন, তারা হত্যা মামলার আসামি। বাজারের বেশ কিছু দোকানপাট তাদের। এ জন্য তারা বাজারে দোকান খুলছে না। তারা নিজেদের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে আমাদের ওপর দোষ দিচ্ছে।
এ বিষয়ে ফুলছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাওছার আলী বলেন, এই হত্যা মামলাটি বর্তমানে সিআইডিতে রয়েছে। দুজন আসামিও গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে। কাবিলপুর বাজারের অধিকাংশ দোকানদার আসামি হওয়ায় পলাতক রয়েছে। তিনি আরও বলেন, দ্রুত কাবিলপুরে চরে শান্তি ফেরানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেই সঙ্গে চরের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য কাজ করছে পুলিশ।
রিপন আকন্দ/এনএ