ক্রাচে বাদাম-বুট সাজিয়ে বিক্রি করে চলছে ইদুলের সংসার
একটি সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় ইদুল মিয়ার (৪৫) ডান পা। পঙ্গু হওয়ায় স্ত্রীও তাকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। নেমে পড়েন জীবন সংগ্রামে। লোহার হাতলে বক্স বানিয়ে তাতে থরে থরে সাজিয়ে বিক্রি করছেন শিমের বিচি, বাদাম, বুট। কারো বোঝা না হয়ে এভাবেই চলছে ইদুল মিয়ার জীবন।
ইদুল মিয়ার বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের গড়পিংলাই আর্দশ গ্রামে। তার বাবার নাম রমজান আলী। তিন ভাইয়ের মধ্যে ইদুল সবার ছোট। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে বর্তমানে শিমের বিচি বিক্রি করে চলছে সংসার।
সরেজমিনে ইদুলের বাড়িতে দেখা যায়, কংক্রিটের নোনা ধরা ইটের তৈরি বাড়ি। বাড়ির ভেতরে টিনের চালা। শোয়ার ঘরের এক পাশে রয়েছে একটি গরু, অন্য পাশে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। টিনের চালের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের আলো। বৃষ্টি এলে মাথা গোঁজার এ ঠাঁইটুকুও থাকে না। বারান্দায় আপন মনে রশি দিয়ে দোল খাচ্ছে তিন বছরের শিশুকন্যা জান্নাতুন। পাশেই দুই হাতে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
প্রতিবেদককে দেখে অনেকটা হতচকিত হয়ে যায় ইদুল মিয়া। কোথায় বসতে দেবেন তিনি। তার বাড়িতে বসার তেমন কিছুই নেই। সেখানেই কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, ১৩ বছর আগে স্যালোচালিত (ইঞ্জিন) পাওয়ার টিলার দিয়ে ধান আনা-নেওয়ার কাজ করতেন তিনি। হঠাৎ একদিন পাশের বাজারে রাস্তার পাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা খায় পাওয়ার টিলারটি। ওই গাড়িতে তিনি চালকের সহযোগীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ঘটনাস্থলেই গাড়ির চালক মারা যান। ডান পা ভেঙে গুরুতর আহত হন তিনি।
তিনি জানান, স্থানীয়রা আহত অবস্থায় তাকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। সেখানে প্রায় ২০ দিন চিকিৎসার পর জ্ঞান ফেরে তার। এরই মধ্যে তার ডান পা কেটে ফেলা হয়। এমন অবস্থায় তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান।
বাবার টানাপোড়েনের সংসারে ফিরে চার শতক জমিতে বাড়ি তৈরি করেন। পরে পাশের গ্রামের আয়শা বেগমকে বিয়ে করেন। অভাবের সংসারে ছেলে সাগর (৯), মিম (৫) এবং জান্নাতুন (৩) নামে তিনটি সন্তান জন্ম নেয়।
যেভাবে চলছে ইদুলের সংসার
সড়ক দুর্ঘটনায় পা এবং স্ত্রীকে হারিয়ে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। বাবার অভাবের সংসারে বোঝা হয়ে এক সময় অত্মহত্যার পথ বেছে নেন। পরে ওই গ্রামের এক ব্যক্তির পরামর্শে তিনি স্থানীয় বাজারে বাজারে শিমের বিচি, বাদাম, বুট বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। সেই ব্যবসা করে কোনো মতো দিন পার করছিলেন তিনি।
এরপর আয়শা বেগমকে বিয়ে করেন। সকাল হলেই আয়শা বেগম স্থানীয় একটি চাতালে শ্রমিকের কাজ করতে যান। আর ইদুল মিয়া লোহার দুই হাতলে বাদাম, শিমের বিচি সাজিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাজারে বাজারে।
মাত্র ৩শ টাকা দিয়ে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন। এখন তার ব্যবসার পুঁজি ১৫শ টাকা। নওগাঁর রাণীগঞ্জের ত্রিমহিনী নামে এক বাজার থেকে ভাজা শিমের বিচি ১৭০ টাকা, বাদাম ৯০ টাকা এবং বুট ৭০ টাকা কেজি দরে কিনে নিয়ে আসেন। প্রতিদিন গড়ে ৭শ থেকে ৮শ টাকার বাদাম বিক্রি করেন তিনি। এতে তার প্রায় ১৫০ টাকা আয় হয়।
ইদুল মিয়া
ইদুল জানান, লোহার হাতলে তৈরি ক্রাচে ভর দিয়ে চলতে হয় তাকে। বহন করার সুবিধার্থে তিনি তার হাতলেই থরে থরে প্লাস্টিকের বক্সে করিয়ে সাজিয়ে নেন বিচিগুলো। প্রতিটি প্যাকেটের দাম ১০ টাকা। এই ব্যবসায় তাকে সহায়তা করেন ৯ বছরের ছেলে সাগর। সাগর স্থানীয় লক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র।
জানতে চাইলে স্ত্রী আয়েশা খাতুন বলেন, অভাবের সংসার দেখে গরিব বাবা তাকে বিয়ে দিয়েছেন। বাবার বাড়ি থেকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছি। কখনো চাতালে আবার কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করে কোনোভাবে সংসার চলছে। জায়গা না থাকায় থাকার ঘরেই গরু রাখছি।
তিনি বলেন, অনেক সময় কাজ না থাকলে অনাহারে থাকতে হয়। সরকার থেকে একটি প্রতিবন্ধী ভাতা পাই। সন্তানদের কোনো কাপড় কিনে দিতে পারি না। নিজেও অসুস্থ। ওষুধ কেনার টাকা না থাকায় চিকিৎসা করাতে পারছি না। অল্প আয়ে কোনো মতো সংসার চলছে।
স্থানীয় খয়ের বাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু তাহের মন্ডল বলেন, ইদুল মিয়া অনেক কষ্ট করে চলছে। লোহার ক্রাচের হাতলে শিমের বিচি, বাদাম নিয়ে ফুলবাড়ি, বিরামপুর, লক্ষীপুরসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে বিক্রি করেন। কষ্ট করলেও তিনি ভিক্ষা করেন না।
দশ মাইল হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত চার মাসে দিনাজপুরের ১৩ উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৩০ জনের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় বেশি।
বর্তমানে দিনাজপুর শহর থেকে শুরু করে উপজেলাগুলোতে রাস্তাঘাট অনেকটা সংকীর্ণ। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অটোবাইক। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল এবং ট্রাক চলাচল করছে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে।
ওহেদুল ইসলাম আটিস, দিনাজপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা
দিনাজপুর নিরাপদ সড়ক চাই এর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য আমরা ১৪৫টি কারণ বের করেছি। তার মধ্যে তিনটি কারণকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। মানুষকে অনেক সচেতন হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। তাহলেই আমরা নিরাপদ থাকব।
এসপি