হবিগঞ্জে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে লাগে ১০ হাজার টাকা

Dhaka Post Desk

আজহারুল মুরাদ, হবিগঞ্জ

০১ মার্চ ২০২৩, ০৮:১৮ পিএম


হবিগঞ্জে ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে লাগে ১০ হাজার টাকা

সকাল সোয়া ৯টা। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), হবিগঞ্জ অফিসের বারান্দায় কয়েকটি তালিকায় নিজের নাম খুঁজছিলেন মাইক্রোবাসচালক মো. আব্দুল ওয়াহিদ। কী খুঁজছেন জিজ্ঞাসা করতেই তিনি জানান, পেশাদার চালকের লাইসেন্স নবায়নের জন্য ২০১৯ সালের ১৯ জুন আবেদন করেছিলেন। ২০২২ সালের ৩ আগস্ট তিনি ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে লার্নার কার্ড নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। এখন স্মার্ট কার্ডের জন্য সপ্তাহে কয়েকদিন এসে তালিকায় নিজের নাম খুঁজেন।

রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), হবিগঞ্জ অফিসে সরেজমিনে সেবাগ্রহীতাদের এমন দুর্ভোগের চিত্র চোখে পড়ে।

সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল সোয়া ৯টায় বিআরটিএ হবিগঞ্জ সার্কেলের অফিস খোলা হয়। তবে এর আগে থেকেই কয়েকজন সেবাগ্রহীতা দরজার সামনে অপেক্ষমাণ ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মানুষের ভিড়। তবে হবিগঞ্জ বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মু. হাবিবুর রহমান অফিসে আসেন সোয়া ১১টার পর। আর খোঁজ নিয়ে জানা যায় মোটরযান পরিদর্শক মো. হাফিজুল ইসলাম খাঁন ঢাকায় আছেন।

এ সময় চুনারুঘাট উপজেলার দেউন্দি চা-বাগান অফিসের চালক বাধন ভূমিকের সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার কাছ থেকে জানা যায়, গত বছরের নভেম্বরে তিনি হবিগঞ্জ বিআরটিএ’র অফিস সহায়ক আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে ডোপ টেস্টের আগে সাড়ে ৬ হাজার টাকায় কন্ট্রাক্ট করেছিলেন এবং ৪ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার সময় আরও দেড় হাজার টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু আব্দুল কাইয়ুম সিলেটে বদলি হয়ে যাওয়ায় এখন বিড়ম্বনা পোহাতে হচ্ছে বাধন ভূমিককে। প্রতিবেদকের সামনেই মুঠোফোনে কাইয়ুমের সঙ্গে কথা বলেন বাধন। কথা শেষে জানান, হবিগঞ্জ অফিসে জাকারিয়া নামে একজনের সঙ্গে দেখা করে বাকী দেড় হাজার টাকা দিতে বলেন। কিন্তু টাকা নেই জানালে, অন্য কোনো সময় টাকা নিয়ে এসে যোগাযোগ করতে বলেন কাইয়ুম।

পরে এই প্রতিবেদক মুঠোফোনে আব্দুল কাইয়ুমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, হবিগঞ্জের মানুষ আমাকে ভালোবাসে। তাই হবিগঞ্জ ছাড়ার পরও আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

এ সময় বাধন ভূমিকের কাছ থেকে হবিগঞ্জে ডোপ টেস্ট না হওয়ার বিড়ম্বনা সম্পর্কে জানা যায়। বাধন বলেন, আমি হবিগঞ্জ বিআরটি’র রসিদ নিয়ে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডোপ টেস্ট করতে যাই। কিন্তু সেখানে রসিদ দিলে তারা সিল ও স্বাক্ষর নেই জানিয়ে ডোপ টেস্ট সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয়। পরে সিলেটে আসা-যাওয়ার খরচের হিসাব করে ৫০০ টাকা অতিরিক্ত দিয়ে ডোপ টেস্ট করাই।

এছাড়া নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি এলাকার পেশাদার চালক মোতালিব মিয়া, মারুফ মিয়াসহ কয়েকজন ডোপ টেস্টের ভোগান্তির কথা জানান।

ডোপ টেস্ট বিষয়ে জানতে চাইলে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ইমতিয়াজ তুহিন জানান, কিট সংকটের কারণে দুই মাস ধরে পেশাদার চালকের ডোপ টেস্ট বন্ধ রয়েছে। তবে খুব দ্রুতই কিট আসার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে হবিগঞ্জ বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) মু. হাবিবুর রহমান বলেন, হবিগঞ্জ হাসপাতালে কিটের সংকটের কারণে পেশাদার চালকদের ডোপ টেস্ট বন্ধ আছে। এই কারণে চালকদের সিলেট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়ে টেস্ট করাতে হচ্ছে।

হবিগঞ্জের পার্শ্ববর্তী জেলা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিরাহিমপুর গ্রামের মো. মারুফ মিয়ার সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, তিনি ১০ বছর ধরে মাইক্রোবাস চালাচ্ছেন। ২০২১ সালে তার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়। এরপর হবিগঞ্জের একজন ব্যক্তির (নাম জানাতে অনিচ্ছুক) মাধ্যমে নবায়নের আবেদন করেন। এরপর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডোপ টেস্ট হলেও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে পারছেন না। যে কারণে কয়েকবার তাকে মামলা ও জরিমানা গুনতে হয়েছে। যদি ফিঙ্গার প্রিন্ট হয়ে যেত তাহলে লার্নার স্লিপের মাধ্যমে চলতে পারতেন। কিন্তু এখন কেউ গাড়ি দিচ্ছে না। এই অবস্থায় পাঁচজনের পরিবার নিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হচ্ছে মারুফ মিয়ার।

এদিকে বিআরটিএ অফিসের ভেতর জাকারিয়া, পানজু, মামুনসহ ৫-৬ জনকে দেখা যায় ফাইল নিয়ে কর্মকর্তাদের কাছে আসা-যাওয়া করতে। পরে জানা যায় তারা অফিসের কেউ নন। অথচ তাদের হাবভাব দেখে বুঝার উপায় নেই যে তারা দালাল।

লোকবল সংকটের কারণে ওই ব্যক্তিরা অফিসের সহায়ক হিসেবে কাজ করছেন বলে জানান সহকারী পরিচালক মু. হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, বর্তমানে অফিসে পাঁচজন পদধারী লোক কাজ করছেন। এছাড়া মাস্টাররোলে কাজ করছেন আরও তিনজন। তারপরও কাজের চাপ সামলানোর জন্য আরও লোকজন প্রয়োজন। তাছাড়া অফিসে কাজ করার মতো জায়গারও অভাব। তাই ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার জায়গা না থাকায় শেষ পর্যন্ত বাথরুম ব্যবহার করতে হচ্ছে।

মাঝারি যানবাহন চালকের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ভারী যানবাহনের লাইসেন্স করার জন্য ঘুরেও শেষ পর্যন্ত তা করতে পারেননি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের মো. নূরউদ্দিন। তিনি একটি ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ট্রেইনার হিসেবে কাজ করেন। ভারী যানবাহনের লাইসেন্স পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে এখন মাঝারি যানবাহনের লাইসেন্স নবায়নের জন্য গত এক বছর যাবত ঘুরছেন। এজন্য তিনি একজনকে ১০ হাজার টাকাও দিয়েছেন। কিন্তু এখনো এর কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না। তবে যে লোককে টাকা দিয়েছেন তার পরিচয় জানাননি নূরউদ্দিন।

এদিকে মৌলভীবাজার বিআরটিএ অফিসের তুলনায় দ্রুত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন উপায়ে আগে লাইসেন্সসহ অন্যান্য কাজ করা যায় বলে শ্রীমঙ্গল থেকে লোকজন হবিগঞ্জ অফিসে কাজ করাতে আসেন। মোটরসাইকেলের চালক হিসেবে লাইসেন্স নেওয়ার জন্য আসা এরকমই কয়েকজন তরুণের সঙ্গে বিআরটিএ অফিসের সামনে দেখা হয়। তারা সবাই শ্রীমঙ্গল থেকে এসেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেই তরুণরা জানান, হবিগঞ্জে বিভিন্ন উপায়ে দ্রুত লাইসেন্স পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে শুধু আবেদনে বর্তমান ঠিকানা হিসেবে হবিগঞ্জের কোনো একটি ভুয়া ঠিকানা দিলেই হয়। এই তরুণরা যে ব্যক্তির মাধ্যমে কাজ করছেন, তার নাম কোনোভাবেই বলতে রাজি হননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হবিগঞ্জ বিআরটিএ অফিসের সঙ্গে কয়েকটি অনলাইন আবেদনকারী দোকানের সম্পর্ক রয়েছে। বিআরটিএ’র যেকোনো ফরম প্রয়োজন হলেই সেই দোকানগুলো থেকে আনতে বলা হয়। এই দোকানগুলোর সামনে ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের আনাচে-কানাচে হবিগঞ্জ বিআরটিএ’র কর্মচারী ও সম্পৃক্ত লোকজনকে সেবাগ্রহীতাদের নিয়ে গোপনে কথা বলতেও দেখা যায়।

দালালদের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), হবিগঞ্জ সার্কেল অফিসের সহকারী পরিচালক মু. হাবিবুর রহমান হবিগঞ্জ বিআরটিএ অফিসে দালালের কোনো উৎপাত নেই বলে দাবি করেন।

বিআরটিএ’র সেবাগ্রহীতাদের দুর্ভোগ বিষয়ে মু. হাবিবুর রহমান বলেন, সফটওয়্যারের কারণে আমরা সঠিক সময়ে সেবা দিতে পারছি না। যে কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই এসব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। তখন ঘরে বসেই বিআরটি’র সেবা পাওয়া যাবে।

তিনি আরও জানান, হবিগঞ্জ জেলায় ২৫ হাজার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে চালকের লাইসেন্স আছে ১১ হাজার। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা সর্বাধিক ১৬ হাজার।

এমজেইউ

Link copied