মাছ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শামীম ওসমান

আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে নারায়ণগঞ্জ। কালের সাক্ষী ‘বায়তুল আমান ভবন’। যার ইতিহাস কয়েক দফায় উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে।
বায়তুল আমান ভবনের মালিক নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে ঘিরে রয়েছে ওসমান পরিবারের তিন পুরুষের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এক মধুর স্মৃতি প্রায়ই বলেন ওসমান পরিবারের অন্যতম সদস্য নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার (১৭ মার্চ) ঢাকা পোস্টের কাছে আবারও সেই স্মৃতিচারণ করেছেন শামীম ওসমান। চিকিৎসার জন্য শামীম ওসমান ও তার স্ত্রী বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। ফলে টেলিফোনে স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি।
স্মৃতিচারণের শুরুতেই শামীম ওসমান বলেন, বঙ্গবন্ধু কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন; কেবল তার সান্নিধ্যে থাকা লোকেরাই জানেন। চাইলেও কেউ তার মতো হতে পারবে না। ছোটবেলায় মায়ের (ভাষাসৈনিক মরহুম নাগিনা জোহা) কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বঙ্গবন্ধু কী? মা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।
ঘটনাটি ১৯৭৪ সালের। একদিন রাতে আমাদের বাসার ফোন বেজে উঠল। আমি ধরে সালাম দিলাম। অপরপ্রান্ত থেকে বেশ দরাজ কণ্ঠে ‘কে’ জিজ্ঞাসা করতেই আমি বললাম শামীম। অপরপ্রান্ত থেকে বললেন, ফোন তোর বাবারে দে। তখন আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। বাবাকে (স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত একেএম সামসুজ্জোহা) বললাম, কে যেন ফোন করে বলছেন, তোর বাবাকে দে। বাবা কথা শুনেই বুঝতে পারলেন। বললেন, বঙ্গবন্ধুর ফোন। বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললেন বঙ্গবন্ধু। জানতে পারলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আসবেন। নারায়ণগঞ্জ তখন মাছের জন্য বিখ্যাত। তাই বঙ্গবন্ধু আমার বাবাকে মাছ দিতে বলেছেন। বাবা আমাকে বলল, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাবি। শুনে তো আমার রক্ত গরম হওয়ার মতো অবস্থা।
শামীম ওসমান, সংসদ সদস্য
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমি একা মাছ নিয়ে যাব শুনে সারারাত ঘুমাতে পারিনি। ভোর ৪টার দিকে সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট পরে আমাদের পুরোনো গাড়ির চালক আজগর চাচাকে নিয়ে ধানমন্ডিতে গেলাম। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দেখলাম দুজন প্রহরী। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছিল, রাষ্ট্রপতির বাসায় যাব, অনেক গার্ড থাকবে, বিশাল ঘর থাকবে। আমাদের গাড়িচালক আজগর চাচার কণ্ঠস্বর ছিল অনেক ভারী। তিনি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেট খুলতে বললে পুলিশ রাজি হচ্ছিল না। আজগর চাচা বলে ফেললেন, আমারে চেনো না; গেট খোলো। পুলিশ জানায়, আপনাদের চিনে কাজ নেই। সাহেব এখনো ঘুমে, পিএস আসেনি।
শামীম ওসমান বলেন, এরই মধ্যে দেখলাম ভবনের তিনতলায় বঙ্গবন্ধু সাদা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে পাইপ। তিনতলা থেকে তিনি বললেন, ‘কে রে’। তখন আজগর চাচা বললেন, নারায়ণগঞ্জ থেকে আসছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, কে, আজগর?। উত্তরে আজগর চাচা বললেন, হ্যাঁ। আপনি কি অহন আর আমাদের চিনবেন। এখন তো আপনি রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধু বললেন, দাঁড়া আমি নামতেছি। কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধু নিচে নেমে এলেন।
নিচে এসে আমাকে বললেন, কিরে লেখাপড়া ঠিকমতো করিস তো। তোর মা কেমন আছে। আমি উত্তর দিলাম পড়ালেখা ঠিকমতো করি। মা ভালো আছে। বঙ্গবন্ধু বললেন, যা তোর চাচি রান্নাঘরে আছে; মাছ নিয়ে যা। তখন আমার প্রচুর রাগ উঠল। কারণ মাছটির ওজন ছিল আমার চেয়েও বেশি। আমি হলাম মালিক; আমাকে বলে মাছ নিয়ে যেতে। পরে পুলিশের সহায়তায় মাছটি নিয়ে গেলাম। অন্যদিকে আজগর চাচার কাঁধে হাত রেখে রুমে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু।
শামীম ওসমান, সংসদ সদস্য
শামীম ওসমান বলেন, বঙ্গবন্ধুর কথামতো মাছ নিয়ে গেলাম রান্নাঘরে। সেখানে গিয়ে আমি অবাক। বঙ্গমাতা রান্না ঘরে। আমার কাছ থেকে মাছ নিয়ে কাটতে শুরু করলেন। আমি আরও অবাক হলাম। বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী রান্না করছেন। আমাকে বসতে দিলেন পিঁড়িতে। আমি তখন বাধ্য হয়েই বসলাম। পরে নাশতা দিলেন মুড়ি ও খেজুরের গুড়। দেখে আমার কান্না হওয়ার উপক্রম হলো। অনেকক্ষণ বসে থাকার পর খেলাম। তখন আমার মায়ের খোঁজখবর নিলেন বঙ্গমাতা। কারণ তিনিও আমার মাকে ভালোবাসতেন। যাওয়ার সময় বঙ্গমাতা বললেন, ঠিকমতো লেখাপড়া করিস। কিন্তু আমি মনে মনে ভাবছি, বাসায় গিয়ে আব্বুকে বলব, আমাকে আর কখনো ওই বাড়িতে পাঠাবেন না।
তিনি বলেন, আমরা বের হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন ঠিকমতো পড়ালেখা করিস কিন্তু। ওই সময়েও আজগর চাচার কাঁধে বঙ্গবন্ধুর হাত ছিল। পরে গাড়িতে ওঠার পর আজগর চাচাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি নাশতা খেয়েছেন? বললেন, পাউরুটি। বললাম আপনাকে বঙ্গবন্ধু এতো ভালোবাসেন কেন? আজগর চাচা বললেন, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকার কয়েকটি স্থানে আত্মগোপনে ছিলেন। তখন সঙ্গে ছিলাম আমিও। এজন্য আট বছর পরও ১৯৭৪ সালে আজগর চাচার কণ্ঠস্বর শুনেই চিনেছেন বঙ্গবন্ধু। এমনই মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি ছিলেন আমজনতার। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। তাই বলি, আমরা চাইলেও বঙ্গবন্ধুর মতো হতে পারব না, সম্ভবও না। শুধু তার আদর্শকে অনুসরণ করতে পারি মাত্র। অবশ্য ওই দিনের ঘটনা বাসায় গিয়ে আব্বুকে বলিনি।
এএম