‘হামার তিস্তাপাড়ের মানুষগুলার বারো মাসই কষ্ট’

Dhaka Post Desk

মো. জুয়েল রানা, কুড়িগ্রাম

২২ মার্চ ২০২৩, ০৪:০২ পিএম


‘হামার তিস্তাপাড়ের মানুষগুলার বারো মাসই কষ্ট’

‘আগোত হামরা ২৫-৩০ ফুট মাটির নিচোত থাকি বোডিং দিয়া পানি তুলি আবাদ করছি। তখন আবাদ করা সহজ আছিল। এলা ৫০ ফিট বোডিং করলেও পানি পাওয়া যায় না। নদীত পানি না থাকার জন্য এ অবস্থা। চরোত হামারগুলার আবাদ করা খুব সমস্যা হইছে। আবাদে খরচও অনেক মেলা।’

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার তিস্তা নদীর অববাহিকার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খেতাব খাঁ গ্রামের কৃষক মন্ডল আলী (৬৫)।

তিনি বলেন, ‘নদীর ওপারে হামার জমি। এলা নদীত হাঁটু পানি। নৌকা চলে না, অন্য কোনো গাড়িও চলে না। তারপরও কষ্ট করি যে আবাদটা করি বাড়িত আনা কী যে কষ্ট বলার ভাষা নেই। আবার যখন বন্যা আইসে, ভারত পানি ছাড়ি দেয়, সব ভাসি নিয়া যায়। বাড়িঘর ছাড়ি অন্য জায়গাত যেয়া থাকি। হামার ১২ মাস কষ্ট। ছয়টা মাস যে ভালো থাকমো তাও পাই না। ভারতে যে কী দুর্ভোগত ফেলাইছে হামাক বাবা।’ 

দেশের ভেতরে প্রবাহিত ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিস্তার ৪০ কিলোমিটার পড়েছে কুড়িগ্রাম অংশে। উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে উত্তরাঞ্চলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আবার বর্ষা মৌসুমে একতরফাভাবে ছেড়ে দেওয়া পানি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এ অঞ্চলের জনজীবন। ২০১১, ২০১৪, ২০১৫ ও সর্বশেষ ২০১৯ সালে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে দুই দেশ দীর্ঘ বৈঠকে বসলেও হতাশা থেকেই গেছে। এখনও কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে আবার জলবিদ্যুৎ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহারের খবর এসেছে

একই এলাকার নজরুল ইসলাম নামের আরেক কৃষক বলেন, আমি তিস্তার চরে প্রায় ছয় একর জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ করেছি। কিন্তু ঠিক মতো পানি দিতে পারছি না। নদীতে পানি না থাকায় এ অবস্থা। আগে যে জমিতে পানি দিতে এক ঘণ্টা সময় লাগত, এখন দুই ঘণ্টা সময় লাগে। জমিতে কোনো রস নেই। এছাড়া যাতায়াতের বড় সমস্যা এখন। নৌকাও চলে না, নদীত হাঁটু পানি। ফসল কীভাবে বাড়িতে আনব, সেই চিন্তায় বাঁচি না।

dhakapost

এদিকে, তিস্তার উজানে ভারতীয় অংশে নতুন দুটি খাল খনন ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহারের খবরে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিস্তাপাড়ের মানুষ। শুকনো মৌসুমে পানি থাকছে না, আবার বর্ষা মৌসুমে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেওয়ায় দুই কূল ছাপিয়ে ভাঙছে ঘরবাড়ি, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি। এ অবস্থায় উভয় সংকটে পড়েছেন তিস্তার দুই পাড়ের কৃষকসহ সাধারণ মানুষ।

এরই মধ্যে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়, নতুন করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার রাজ্যের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করবেন। এজন্য দুটি খাল ও ছোট ছোট ১০টি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের যাবতীয় প্রস্তুতি ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বড় কারণ।

তিস্তা নদীর অববাহিকার কৃষকরা জানান, নতুন করে তিস্তার পানি আরও প্রত্যাহার করা হলে তাদের জীবন-জীবিকা সংকটাপন্ন হয়ে পড়বে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশ একেবারে শুকিয়ে যাবে। এতে নদীর তলদেশ ভরাট হওয়াসহ পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে। তখন গভীর নলকূপ বসিয়েও চাষাবাদের জন্য পানি পাওয়া যাবে না। অন্যদিকে, তলদেশ ভরাট হলে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে নেমে আসা পানি আরও আগ্রাসী হয়ে দুই কূলে আঘাত হানবে। ঘরবাড়ি হারাবে হাজার হাজার পরিবার। এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অংশের ৪০ কিলোমিটারব্যাপী প্রবাহিত এ নদীর দুই পাড়ের মানুষের ওপর। 

কুড়িগ্রামের ১৬টি চরে ৪৫ হাজার হেক্টর জমি আবাদি। এর মধ্যে প্রায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে বাদাম, রসুন, পেঁয়াজ, ভুট্টা, কাউন, মিষ্টিকুমড়া, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। তবে, শুধু তিস্তা নদীর অববাহিকায় কী পরিমাণ ফসল আবাদ হয় তা জানাতে পারেনি কৃষি বিভাগ

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (খামার বাড়ি) অফিস সূত্রে জানা গেছে, কুড়িগ্রামের ১৬টি চরে ৪৫ হাজার হেক্টর জমি আবাদি। এর মধ্যে প্রায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে বাদাম, রসুন, পেঁয়াজ, ভুট্টা, কাউন, মিষ্টিকুমড়া, মরিচসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। তবে, শুধু তিস্তা নদীর অববাহিকায় কী পরিমাণ ফসল আবাদ হয় তা জানাতে পারেনি কৃষি বিভাগ। 

জানা গেছে, তিস্তা নদীটি নীলফামারী সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লালমনিরহাট হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলা হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ নদীর ৪০ কিলোমিটার কুড়িগ্রাম অংশে পড়েছে। উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে উত্তরাঞ্চলে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। আবার বর্ষা মৌসুমে একতরফাভাবে ছেড়ে দেওয়া পানি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এ অঞ্চলের জনজীবন। ২০১১, ২০১৪, ২০১৫ ও সর্বশেষ ২০১৯ সালে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে দুই দেশ দীর্ঘ বৈঠকে বসলেও হতাশা থেকেই গেছে। এখনও কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে আবার জলবিদ্যুৎ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহারের খবর এসেছে।

dhakapost

রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের রামহরি গ্রামের জেলে রহিম মিয়া বলেন, নদীতে পানি নেই, মাছও নেই। সারাদিন মাছ ধরলে ৩০০-৪০০ টাকা বিক্রি করা যায়। এ আয় দিয়ে সংসার চলে না। আগে নদীতে মাছ ধরে দুই-তিন হাজার টাকা আয় করা যেত। মাছ ধরেই জীবনটা শেষ করলাম। এ বয়সে অন্য কোনো কাজও করতে পারছি না। নদীতে যদি পানি না থাকে তাহলে কী করে সংসার চালাব, বুঝতে পারছি না।

কুড়িগ্রামের রেল ও নৌ যোগাযোগ এবং পরিবেশ উন্নয়ন কমিটির সংগঠক খন্দকার আরিফ বলেন, তিস্তা নদীর সংকটে কয়েক লাখ মানুষ ভুক্তভোগী। প্রয়োজনে তিস্তার পানি পাওয়া যায় না, অসময়ে পানিতে এখানকার জনজীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে। শুধু রাজারহাট উপজেলায় ২০১৭ সাল থেকে এক হাজারের ওপর পরিবার তিস্তার ভাঙনে ভিটেমাটি হাড়িয়ে নিঃস্ব হয়েছে। তিস্তার পানি প্রত্যাহারের কারণে এর অববাহিকার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমির চাষাবাদে সমস্যা হচ্ছে। এখন যদি তিস্তার পানিতে জলবিদ্যুৎ নির্মাণ করা হয় তাহলে এ অঞ্চলের মানুষের কৃষি ও জীবন-জীবিকা সংকটাপন্ন হবে। 

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামার বাড়ি) উপপরিচালক কৃষিবিদ বিপ্লব কুমার মোহন্ত বলেন, নদীতে শুষ্ক মৌসুমে পানি কম থাকায় আবাদ কিছুটা কম হচ্ছে। আবার যদি ভারতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র হয় তাহলে তো পানিপ্রবাহ আরও বাধাগ্রস্ত হবে। এখানকার কৃষি খাতের উৎপাদন আরও কমে যাবে। 

একুশে পদকপ্রাপ্ত আইনজীবী এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, নদী কোনো রাষ্ট্রের একক সম্পদ নয়, এটি আন্তর্জাতিক সম্পদ। তিস্তার পানি না পাওয়ার ফলে আমাদের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। প্রকৃতি ভারসাম্য হারাচ্ছে। এখানে মরুকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিস্তা থেকে যে পানি পাওয়ার কথা তা আমরা পাচ্ছি না। এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি হলেও ভারত-বাংলাদেশ দুটি পৃথক রাষ্ট্র। তাদের সমস্যার কারণে আমাদের পানি না পাওয়াটা দুঃখজনক।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ্-আল-মামুন বলেন, শুষ্ক মৌসুমে কয়েক বছর থেকে তিস্তায় পানি থাকছে না। এটা যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়েছে। তিস্তার তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। বর্ষার মৌসুমে অনেক পানি আসে যা তিস্তার ধারণক্ষমতার বাইরে। নদীগুলোর ড্রেজিং করা দরকার। আমাদের সমীক্ষা চলছে।

ভারতীয় অংশে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে আপনারা যা জানেন, আমিও তা-ই জানি।

 এমজেইউ

Link copied