আমি মারা গেলে সমাজসেবা যদি টাকা দেয়, সেটা দিয়ে কী হবে!

আর কতদিন পর ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারব? সরকার তো টাকা ঠিকে দেয় কিন্তু আমি পাচ্ছি না। সমাজসেবা কার্যালয়ে আবেদন করেছি প্রায় এক বছর হচ্ছে। তারা শুধু হবে হবে করে মাসের পর মাস আমাকে ঘুরাচ্ছে। আজও কোনো সরকারি সহায়তা পাইনি। উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছি না। আমি মারা গেলে সমাজসেবা যদি টাকা দেয়, সেটা দিয়ে কি হবে? আমি বাঁচতে চাই, আমার মা-সন্তান, পরিবারের জন্য আমাকে বাঁচতে হবে।
এভাবে অশ্রুসিক্ত নয়নে কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক মজিদুল ইসলাম। তিনি মরণব্যাধি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। এক বেলা কাজ না করলে সংসার চলে না। আবার উন্নত চিকিৎসার জন্য তার নেই পর্যাপ্ত অর্থ। তাই নিজের কথা বাদ দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে অসুস্থ শরীর নিয়েও তাকে রিকশা নিয়ে বের হতে হয়।
রংপুর শহরে রিকশা চালান মজিদুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) সকালে নগরীর স্টেশন রোডে কথা হয় এই রিকশাচালকের সঙ্গে। কথা বলার সময় বারবার হাঁপাচ্ছিলেন তিনি। চোখেমুখে অন্ধকারের ছাপ। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে না পারার আক্ষেপ তার মনে।
মজিদুল ইসলাম জানান, দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্লাড ক্যানসারে ভুগছেন তিনি। পরিবারে বিধবা মা, স্ত্রী আর সন্তান রয়েছে। তাদের মুখের দিকে চেয়ে আয় রোজগারে নিজের গ্রাম ছেড়ে রিকশা চালাতে এসেছেন বিভাগীয় শহর রংপুরে। কাঁদতে কাঁদতে রক্তে জমাট বাধা কষ্টের কথা শোনালেন মজিদুল। তার রিকশার পেছনে সাঁটানো পোস্টারে লেখা : ‘ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত মজিদুল ইসলাম। আর্থিক সাহায্যের আবেদন’।
মজিদুল ইসলামের বয়স ৪২। বাড়ি লালমনিরহাটের হারাটি ইউনিয়নের মহেন্দ্রনগর কাজীর চাওড়া গ্রামে। তার বাবা মৃত শামছুল ইসলাম, মা বিধবা মর্জিনা বেগম। চার সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে মজিদুল এখন নিঃস্ব। পরিবার নিয়ে ছোট এরশাদুল ইসলামের বাড়িতে ছোট্ট একটি ঘরে থাকছেন তিনি।
তিনি জানান, তার বসতভিটা নেই। নেই তিন বেলা তৃপ্তি করে খাওয়ার সামর্থ্য। অভাব-অনটনের মধ্যেই বিধবা মা আর নিজ স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে রিকশা চালালেও মজিদুল ইসলাম দীর্ঘ ১৮ বছর লালমনিরহাট-পাটগ্রাম রুটে মিঠু পরিবহন বাসের সহকারী (হেলপার) ছিলেন। ২০২১ সালের মাঝামাঝি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নিশ্চিত হন তিনি ব্লাড ক্যানসারে (লিউকোমিয়া) আক্রান্ত।
মজিদুল আরও বলেন, ক্যানসার আক্রান্ত হবার পর থেকে লালমনিরহাট এবং রংপুরে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু টাকার অভাবে কোথাও ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারিনি। রিকশা চালিয়ে যা আয় হয়, তা দিয়ে ওষুধ কিনব নাকি সংসারে দিবো? নিজের সংসার, তিন ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ কোনোটাই ঠিকমতো চালাতে পারছি না। ক্যানসার ধরা পরার পর থেকে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। জমিজমা যা ছিল সব শেষ। এখন পর্যন্ত তিন-চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন আর হাতে টাকা-পয়সা নেই। রিকশা চালিয়ে তো চিকিৎসার টাকা জোগার সম্ভব না। দেশের বিত্তবান মানুষসহ সরকারের সহযোগিতা দরকার।
গত বছরের এপ্রিলে অসুস্থ হন মজিদুল ইসলাম। টানা চার মাস রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং লালমনিরহাট হাসপাতালে দুই মাস চিকিৎসা নেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক আহসান হাবীব, চিকিৎসক আশকুল আরেফিনসহ বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের অধীনে ছিলেন। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় অথবা ভারতের চেন্নাইয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এজন্য সব মিলে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হতে পারে। কিন্তু ভূমিহীন হতদরিদ্র পরিবারের পক্ষে এতো টাকা ব্যয় করা সম্ভব নয়। তাই অন্যের সহায়তা ও সহযোগিতার আশায় বাঁচার স্বপ্ন দেখছেন এই রিকশাচালক।
মজিদুল ইসলাম রংপুর নগরীর আনছারী মোড় এলাকার জব্বার মিয়ার গ্যারেজ থেকে নেওয়া রিকশা চালান। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রীদের নিয়ে নগরীর বিভিন্নপ্রাপ্ত ছুটে বেড়ান। রাত হলে আবার সেই গ্যারেজে ফিরে যান। সেখানের রাতযাপন করেন। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা তার আয় হয়। এর মধ্যে গ্যারেজে রিকশার জমা দিতে হয় ২৫০ টাকা। বাকি টাকা থেকে সংসার ও নিজের টুকটাক ওষুধ কিনে খান।
লালমনিরহাট জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তর কার্যালয়ে গত বছরের ১০ মে আর্থিক সহায়তা চেয়ে আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা মেলেনি।
এ নিয়ে রংপুর বিভাগীয় সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল মতিন জানান, গত মে মাসের ১০ তারিখে ক্যানসার আক্রান্ত মজিদুল আবেদন করেছেন। আমরা তার আবেদনসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখেছি। আশা করছি ঈদুল ফিতরের পর তাকে সরকারি সহায়তার অর্থ প্রদান করা সম্ভব হবে।
লালমনিরহাটের হারাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম খন্দকার বলেন, আমি ওই রিকশাচালকের অসুস্থতার কথা শুনেছি। নিজের সামর্থ্য থেকে তাকে সহযোগিতাও করেছি। পাশাপাশি আমি নিজেই তাকে রক্ত দিয়েছি। তার চিকিৎসার জন্য গ্রামের মানুষসহ দেশের বিত্তবান মানুষ এগিয়ে এলে পরিবারটি উপকৃত হবে।
মজিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে এই ০১৭১০৫৬৫১২৯ (বিকাশ) নম্বরে কথা বলা যাবে। এ ছাড়া রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক লিমিটেড, লালমনিরহাট হারাটি বন্দর শাখা, হিসাবের নাম মো. মজিদুল ইসলাম, হিসাব নম্বর-১২২/১০৮৯৩ (সঞ্চয়ী) নামে তার অ্যাকাউন্ট রয়েছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএএস