ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চা বাগান কেটে ফেলছেন পঞ্চগড়ের চাষিরা

সমতল ভূমিতে চা শিল্পে বিপ্লব ঘটলেও কয়েক বছর ধরে চা চাষিদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। তাদের অভিযোগ, চা শিল্পকে ঘিরে এক ধরনের সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় বাগানের উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি চলতি মৌসুমে কারখানাগুলো যে দামে চা পাতা কিনছে তাতে উৎপাদন খরচও উঠছে না। ফলে বছরের শুরুতেই লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে দাবি চাষিদের। এমন অবস্থায় ক্ষোভে চা বাগান কেটে ফেলছেন অনেক চাষি।
চা চাষিদের অভিযোগ, শুরুর দিকে কেজিপ্রতি চা পাতার দাম পেতেন ৩০ থেকে ৪০ টাকা। কিন্তু বর্তমানে কারখানার মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে ১৮ টাকার উপরে দাম পাচ্ছেন না তারা। চলতি বছর মার্চ থেকে চা পাতা কিনছেন কারখানার মালিকরা। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত থাকে চায়ের ভরা মৌসুম। কিন্তু শুরুতেই কারখানার মালিকরা সিন্ডিকেট তৈরি করে দাম কমিয়ে চাষিদের কাছ থেকে ১৩ থেকে ১৫ টাকায় পাতা কিনছেন। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কেটে নিচ্ছেন ৪০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত পাতা।
চা চাষিরা জানান, প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। আর সেই চা পাতা কারখানায় নিয়ে বিক্রি করে উৎপাদন খরচও আসছে না। দিনের পর দিন অসাধু ব্যক্তিদের গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে লোকসান গুনছেন সমতলের ৭ হাজারের বেশি চা চাষি। ঋণ করে চায়ে বিনিয়োগ করেও প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন তারা। তাই অনেকে ক্ষোভে তাদের স্বপ্নের বাগান কেটে ফেলছেন।
জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার চিমনজোত এলাকার চা চাষি কাজিমদ্দিন ও সাঈদসহ কয়েকজনকে তাদের চা বাগান কেটে ফেলতে দেখা যায়। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্ত কেন জানতে চাইলে কাজিমদ্দিন বলেন, চা চাষে লাভবান হতে এক বিঘা জমিতে চা আবাদ করেছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে আর পারছি না। চা পাতার দাম নেই। বাজারে চাল-ডাল বাকি নিতে গেলেও দোকানদাররা বাকি দিতে চান না। চা পাতা বিক্রি করে টাকা দেওয়ার কথা বললে উল্টো তারা বলেন, ‘চা পাতার তো দামই নেই, টাকা দিবা কেমনে? এজন্য তারা বাকিও দেয় না। তাই চা বাগান কেটে ভিন্ন আবাদের কথা ভাবছি।’

শারিয়ালজোতের চা চাষি সাঈদ আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক বিঘার মতো চা বাগান করেছি। কিন্তু চা পাতার দাম সেভাবে দাম পাচ্ছি না। সরকারিভাবে চা পাতার দাম ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কারখানাগুলো ১৩ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে পাতা কিনছেন। তার মধ্যে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সেখান থেকে ৩০-৫০ শতাংশ পর্যন্ত পাতা কেটে নিচ্ছেন। ১০০ কেজি পাতা কারখানায় নিলে ৫০ কেজি কেটে নিচ্ছে। বাকি ৫০ কেজির দামও পাচ্ছি কম। ঘর থেকে আর কত লোকসান গুনবো। সার-কীটনাশক, শ্রমিক খরচও উঠছে না। তাই চা আবাদ বাদ দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় দেখছি না।
একই অভিযোগ ইউসুফ আলী, সোহাগ হোসেন, বাদশা, সিদ্দিক ও বাসেদসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার চা চাষিদের। চা পাতার ন্যায্য দাম পেতে বিভিন্ন সময় আন্দোলনও করেছেন বলে দাবি তাদের।
চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা শিল্পের বিপ্লব ঘটে। গত দুই দশকে বদলে যায় তার চিত্রপট। এক সময়ের পতিত জমি হয়ে ওঠে সবুজ চা বাগান। সবুজ পাতায় জেগে ওঠে নতুন অর্থনীতি। চা উৎপাদনে সিলেটের পর দ্বিতীয় অঞ্চল হয়ে উঠে এ জেলা। প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে সাত হাজার চা বাগান। শুধু পঞ্চগড় থেকেই গত বছর এক কোটি ৫২ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদন হয়েছে। জেলার লক্ষাধিক মানুষ জড়িয়ে পড়েছেন চা শিল্পে। বেকারদের একটি বড় অংশ চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে চা চাষে বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে জেলায় ২৩টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে।
চা বিশেষজ্ঞদের মতে, পঞ্চগড় তথা উত্তরাঞ্চলের উৎপাদিত চায়ের মান খুবই উন্নত, যা দার্জিলিং ভ্যারাইটির মতো। অথচ নিম্নমানের তৈরি চা অকশন মার্কেটে তুলে নিলাম মূল্য অনুযায়ী প্রতি বছর কাঁচা চা পাতার মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের চাষিরা লাভের পরিবর্তে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
তবে সিন্ডিকেটের কথা অস্বীকার করে কারখানা মালিকরা জানান, ভালো মানের চায়ের পূর্বশর্ত হলো দুটি পাতা একটি কুঁড়ি হিসেবে বাগান থেকে চা তুলতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে জেলা চা পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটি কর্তৃক ৪ পাতা পর্যন্ত অনুমোদন করে। কিন্তু চা চাষিরা আট থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত চা তুলে কারখানায় নিয়ে আসেন। তাই বাধ্য হয়ে নির্ধারিত ওজনের তুলনায় কিছু কর্তন করতে হয়। এছাড়া মান নিয়ন্ত্রণ না করায় চট্টগ্রামের অকশন মার্কেটে পঞ্চগড়ের চা তুলনামূলক কম দামে বিক্রি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সাড়ে চার থেকে পাঁচ কেজি কাঁচা পাতা থেকে এক কেজি তৈরিকৃত (মেড টি) চা হয়। কারখানায় এ চায়ের উৎপাদন খরচও অনেক বেশি পড়ে যায়। তাই মালিকরাও লোকসানের ঝুঁকিতে থাকে। নিলাম বাজারে চায়ের মান না থাকায় কম মূল্যে বিক্রি ও মানসম্পন্ন চা পাতা সরবরাহ না করায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা। চা চাষিরা মান ঠিক রেখে চা পাতা তুললে তৈরিকৃত চায়ের মান বৃদ্ধি পাবে। সেক্ষেত্রে অকশন মার্কেটে মূল্য বৃদ্ধি হলে কারখানা মালিকরাও চায়ের কাঁচা পাতার মূল্য বাড়াতে পারবে বলে জানান তারা।

আওয়ামী কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি আব্দুল লতিফ তারিন বলেন, এ জেলার মধ্যে তেঁতুলিয়ার বেশির ভাগ মানুষ চা চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তারা চা পাতার দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে গুনতে হতাশ হয়ে পড়েছেন। কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে পড়ে লোকসান হওয়ায় তারা বাগান ভেঙে ফেলছেন। কারখানা মালিকরা দাম কমার পেছনে বড় পাতাকে দায়ী করছেন। কিন্তু তারা কম দাম ও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন থেকে বাদ দিয়ে ঠিকই বড় পাতা নিয়েই চা বানাচ্ছেন। এছাড়া তারা ভালো মানের চা কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজসে প্রতিদিন কালোবাজারে বিক্রি করছেন। আর নিম্নমানের চা নিলাম বাজারে সরবরাহ করে কম দাম পাওয়ার অভিযোগ তুলছেন। তাই বিষয়টি নিয়ে চা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলেছি। একইসঙ্গে উত্তরাঞ্চলের চা শিল্প বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেডের ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রামের অকশন মার্কেটে সিলেটের তৈরিকৃত চায়ের তুলনায় আমাদের চায়ের দাম কম। কারণ তারা যে নিয়ম মেনে বাগান থেকে চা উত্তোলন করে, আমরা সেই নিয়মের ধারেকাছেও নেই। আমাদের এখানকার ক্ষুদ্র চা চাষিরা হাতের বদলে কাঁচি দিয়ে আট থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত ডালসহ কেটে কারখানায় নিয়ে আসেন। অথচ নির্ধারণ করা আছে চার থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত। এ কারণে আমরাও চায়ের মান ঠিক রাখতে পারছি না। যার কারণে আমাদের চায়ের চাহিদা কমে যায়। চাহিদা কমে গেলে দামও কমে যায়। তাই চা চাষিরা ভালো মানের পাতা সরবরাহ করলে আমরা মূল্য নির্ধারণ কমিটির দর অনুযায়ী কাঁচা পাতা কিনব। সেক্ষেত্রে আমরাও ভালো মানের চা উৎপাদন করতে পারব এবং অকশন মার্কেটে আমাদের চায়ের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে।
তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের পরিচালক সাইদুর রহমান মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে চাষিরা যে সিন্ডিকেটের কথা বলছেন তা ঠিক নয়। মূলত তারা কারখানায় ভালো মানের পাতা দিতে পারছেন না। আর এবারের প্রকৃতি অনুকূলে না থাকায় খরার কারণে অনেক কৃষকের চা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে ভালো পাতা পাচ্ছি না। দুটি পাতা একটি কুড়ি অর্থাৎ তিন পাতা থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত আমরা ১৮ টাকার মধ্যে নিতে পারি। কিন্তু চাষিরা বাগান থেকে কাচি দিয়ে কেটে ৭-৮ পাতা পর্যন্ত নিয়ে আসছেন। এখানে আমরাও নিরুপায়। ভালোপাতা না পেলে ভালো প্রডাকশন কীভাবে করব? নিলাম বাজারে যদি দাম না পাই তাহলে চাষিদের কীভাবে ভালো দাম দিতে পারি। এক্ষেত্রে চাষিরা যদি তাদের বাগানে কাচি দিয়ে নয়, মেশিনের সাহায্যে পাতা তুলতে পারেন তাহলে তারা দাম পাবেন। তাই চা বোর্ডকে চা শিল্পকে বাঁচাতে আরও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে সমস্যাটা দুদিকেই। কারখানা মালিকরা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে খেয়াল-খুশি মতো দরে চা পাতা কিনছেন। আর চাষিরাও পাতা তোলার সময় নিয়ম মানছেন না। তারা ৭-৮ পাতা পর্যন্ত বাগান থেকে তুলে কারখানায় নিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষত আমরা চা শিল্প উন্নয়নে কয়েক বছর ধরেই ক্যামেলিয়া নামের স্কুল খুলে চাষিদের হাতে-কলমে শেখাচ্ছি। আগামী মাসে দেশের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র চালু হচ্ছে এ জেলায়। ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে। নিলাম কেন্দ্র চালু হলেও চাষিরা উপকৃত হবেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার কম দাম ও কর্তন করে দাম দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। শিগগিরই চা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসকে দোয়েল/এবিএস