উল্টো করেও সুন্দর লেখে যমুনা

এক দিন দুই দিন নয়, বরং শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই উল্টো করে লেখে যমুনা। উল্টো হলেও বেশ সাবলীল ও সুন্দর তার হাতের লেখা। এভাবে লিখেই এসএসসির মতো এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে স্বপ্ন পূরণ করবে এমনটাই প্রত্যাশা তার।
বলছি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বিরল প্রতিভার অধিকারী যমুনা আক্তারের কথা। উল্টো করে লেখে নেট দুনিয়ার পাশপাশি স্থানীয় পর্যায়ে এলাকাবাসী ও সহপাঠীদের কাছে বেশ পরিচিত তিনি। ঢাকার ডেমরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ দ্বাদশ শ্রেণির এই শিক্ষার্থীর স্বপ্ন চিকিৎসক হয়ে সুবিধা বঞ্চিতদের পাশে দাঁড়ানোর।
রূপগঞ্জ উপজেলার দীঘি বরাবোর বেরিবাধ এলাকার আবুল কালাম তালুকদারের বাড়িতে একটি ছোট ঘরে ভাড়ায় বসবাস করেন কাদের-সেফালি দম্পতি। চা দোকানি কাদের খানের পাঁচ মেয়ের সবার ছোট যমুনা। মেয়েকে চিকিৎসক বানানোর বড় স্বপ্ন থাকলেও সাধ্য নেই তাদের।
মঙ্গলবার (৬ জুন) দুপুরে ওই এলাকায় যমুনার কথা বলতেই এক নামে চিনে ফেলেন স্থানীয়রা। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় যমুনার বাবার দোকানে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কথা হয় কাদের খানের সঙ্গে। সত্তরোর্ধ্ব কাদের জানান মেয়ে যমুনাকে তার নিয়ে বুক ভরা স্বপ্নের কথা। তবে সামর্থ্য না থাকায় মেয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারি সহযোগিতা চাইলেন তিনি।

যমুনার স্কুল শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হলে জানা যায়, অষ্টম শ্রেণি থেকে দীঘি বরাবো এলাকার প্রতিভা বিকাশ স্কুলে পড়াশোনা করে যমুনা। পরে ওই স্কুল থেকে ২০২১ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। বেশ ভাল ফল করেন এসএসসিতে। বর্তমানে তিনি ডেমরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকেই যমুনা বাংলা, ইংরেজী ও গণিতসহ সব কিছুই লিখেন উল্টো করে। প্রথম দিকে বিষয়টি শ্রেণি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে অবাক করার মত হলেও পরবর্তীতে ফলাফল ভালো করায় মানিয়ে নেন তারা। তার এই প্রতিভার জন্য এলকায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তিনি।
একই স্কুলের কাকলী আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি কখনো কোথাও দেখিনি কোনো মানুষকে উল্টো করে লিখতে। তাকে এভাবে লিখতে কেউ শেখায়নি, অথচ সে শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে এভাবেই লিখে আসছেন। তার হাতের লেখাও খুব সুন্দর, প্রসংশা করার মতো। সে যেন তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে সেই দোয়া করি।
সরকার কিংবা সমাজের উচ্চবিত্তরা এগিয়ে এলেই স্কুলের ছুটির ঘন্টার মত আর্থিক অনটনের কারণে যমুনা আক্তারের পড়াশুনা করতে না পাড়ার হতাশার গল্পের ছুটির ঘন্টা বেজে উঠবে বলে বিশ্বাস স্থানীয়দের। যমুনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসুক সামর্থবানরা এমনটাই চাওয়া তার বাবা-মা ও শুভাকঙ্খীদের।
এই বিষয়ে স্থানীয় নয়ন হাওলাদার নামের একজনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, যমুনা মেধাবী হলেও তার বাবা একজন চা দোকানি। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মত অবস্থা তাদের পরিবারের। তার বাবার পক্ষে সম্ভব নয় তাকে চিকিৎসক বানানো। সরকার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা বিত্তবানরা এলেই তার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব হবে।

এই বিষয়ে যমুনা আক্তারের বাবা কাদের খানের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সামর্থ্য নেই মেয়েকে পড়ানোর। অর্থাভাবে আমি তাকে না করেছিলাম, তার প্রবল আগ্রহ থেকে সে নিজে থেকে কলেজে ভর্তি হয়েছে। এখন যদি সরকার এগিয়ে আসে তবেই তাকে পড়াশোনা করাতে পারব।
পরিবারের অনটনের কথা জানিয়ে যমুনা আক্তারের মা সেফালি বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই পর্যন্ত মেয়েকে পড়ালেখা করাতে রীতিমতো আমাদের যুদ্ধ করতে হয়েছে। এখন আমার মেয়ে কলেজে পড়ছে। দারিদ্রতা আর অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা তাকে পড়িয়েছি। তবে ও যে পড়াশোনা করতে চায়, তা আর আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকার কিছুটা সহযোগিতা করলে আমরা খেয়ে না খেয়ে তাকে পড়াতাম। সহযোগিতা ছাড়া তাকে নিয়ে সামনে আগানোর মত সামর্থ্য আমাদের নেই।
যমুনা আক্তার বলেন, আমি আসলে ছোটবেলা থেকে এভাবেই লেখে আসছি। এভাবে লিখতে আমাকে কেউ শেখায়নি। আমি নিজে থেকেই এভাবে লেখি। আমার এই উল্টো লেখার ধরনের কারণে সবার মাঝে এক ধরনের কৌতুহল ও বিস্ময় কাজ করে। আমার স্বপ্ন একজন মানবিক চিকিৎসক হওয়ার। আমি চিকিৎসক হয়ে সমাজের ছিন্নমূল মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে চাই।
তার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুন অর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের স্কুলে সে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভালো ফল নিয়ে এসএসসি পাস করেছে। সে ডেমরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি পরিক্ষার্থী। তার পড়াশুনায়ও বেশ ভালো ও হাতের লেখাও বেশ চমৎকার। সুবর্ণ সুযোগ আছে তার চিকিৎসক হওয়ার। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলেই সে চিকিৎসক হয়ে সমাজের ছিন্নমূল ও সুবিধা বঞ্চিতদের সেবা প্রদানের মধ্য দিয়ে তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।
আরকে