শিশুর মরদেহ গোসল করানোর সময় বুক ফেটে কান্না আসে

এলাকার কারও মৃত্যু হলেই সবার আগে ডাক পড়ে রুহুল আমিনের। তিনি এসে মরদেহ গোসল করানোর পর পরই উদ্যোগ নেওয়া হয় দাফন কাফন সংক্রান্ত অন্য কাজগুলোর। ৩০ বছর ধরে মরদেহের গোসলের কাজ করে করছেন তিনি। এ কারণে এলাকার সবাই তাকে এক নামেই চেনে। রুহুল আমিন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের শতদল আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা।
৩০ বছরের এ জীবনে বহু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন রুহুল আমিন। সম্প্রতি এসব বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। ৪০ বছর ধরে রুহুল আমিন কাঁচা শাক-সবজির ব্যবসা করে আসছেন। ব্যবসার পাশাপাশি নিভৃতেই চালিয়ে যাচ্ছেন মরদেহ গোসল করানোর সেবামূলক এ কাজ।
রুহুল আমিন বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে মরদেহের গোসল করাচ্ছি। গোসল করাতে গিয়ে নিজের ভেতর মৃত্যুর ভয়টাও জেগে উঠেছে বহুবার। একদিন তো এভাবে আমাকেও দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমারও গোসল করাবে কেউ না কেউ। এমন সব অনুভূতি হতে থাকে মনের ভেতর।
মরদেহ গোসল করাতে গিয়ে চোখে পড়েছে অনেক কিছুই। কিছু মরদেহের মুখমণ্ডল যেন নুরানী চেহারায় দেখতে পাই। মনে হয়েছে এ ব্যক্তি ভালো আমল করেছিলেন। আবার কিছু মরদেহের মুখ কালো হতে দেখেছি। তা দেখে নিজের ভেতরও ভয় পেতাম। মানুষের মৃত্যুর সময় কতো কষ্টই না হয়। একবার এক মৃতদেহের গোসল করাতে গেলাম। বেশি সময় হয়নি তিনি মারা গেছেন, গোসল করাতে গিয়ে দেখি পায়খানার রাস্তা দিয়ে মল পড়ছে। সেই সব মলমূত্র পরিচ্ছন্ন করতে গিয়ে অনেক সময় লেগেছিল।
অনেক সময় অনেকে দীর্ঘদিন রোগে বিছানায় পড়ে থাকার পর মারা যান। বেঁচে থাকার সময় রোগেশোকে যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন থেকে মুক্তি পান মৃত্যু দিয়ে। এসব লাশের মুখে হাসি দেখেছি। তা দেখে মনে হয়েছে, তিনি বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে মৃত্যুর পর শান্তিতে আনন্দে ঘুমাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, একবার দুর্ঘটনা মারা যাওয়া একজনের গোসল করাতে গেলাম। দেখলাম তার পেটের ভুড়িটা বের হয়ে আসছে। সেটা বারবার ঢুকিয়ে দিয়ে গোসল করাতে হয়েছে। অনেক সময় মরদেহ গোসল করাতে গিয়ে শরীর স্পর্শ করলে গরম লাগে। মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। একটু পরেই তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠবেন। মনে হয় না, মানুষটা মারা গেছে। তখন খুব খারাপ লাগে। চোখের পানি আটকানো যায় না। মনে হয় সে কতোই না আপনজন।
খুব কষ্ট লাগে শিশুর মরদেহ গোসল করাতে। যেকোনো দুর্ঘটনায় শিশুর মরদেহ গোসল করাতে গিয়ে চোখে পানি চলে আসে। মনে হয়, একটা সন্তানের জন্য কতোই না কষ্ট করে মা-বাবা । তাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখে। অথচ নাড়ী ছেঁড়া ধনের নিথর দেহ পড়ে আছে। বুক ফাটা কান্না চলে আসে তখন। খুব খারাপ লাগে। গোসল করানোর পর সেটাই চোখে ভাসতে থাকে।
গোসল করাতে গিয়ে মরদেহের ওজন কেমন হয় তা জানতে চাইলে রুহুল আমিন জানান, আসলে সব মৃত্যু তো এক রকম হয় না। গোসল করাতে গিয়ে একই রকম মরদেহ দেখি না। বয়স, অসুখ, দুর্ঘটনার নানা ধরনের সঙ্গে সঙ্গে মৃত ব্যক্তির শারীরিক অবস্থারও রকমফের হয়। তাই মানুষ মারা যাওয়ার পর তার দেহের ওজন যেন অনেক বেড়ে যায়। খুব ভারি লাগে তখন। অথচ ওই মানুষটা জীবিতকালে অনেক হালকা ছিলেন।
আরেকবার এক পাগলকে গোসল করাতে গেলাম। তাকে গোসল করাতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। যখন তাকে কবরে শোয়ানো হচ্ছিল, মনে হলো কবরটি আলোয় ভরে গেল। একজন মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই। ধর্মীয় এ শিক্ষা থেকেই আমি বিয়ের আগে থেকেই এ কাজ করে আসছি। সর্বোপরী মরদেহের গোসল করাতে গিয়ে এটাই মনে হয়েছে, প্রত্যেক মানুষকে মৃত্যুর আগে ভালো আমল করা উচিত। আমল নিয়ে মৃত্যুবরণ করলে তার উপযুক্ত পুরস্কার তিনি মৃত্যুর পরই পাবেন। যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন যেন এ সেবামূলক কাজ চালিয়ে যেতে পারি।
এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা রুহুল আমিন। ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে আব্দুর রাজ্জাককে ধর্মীয় শিক্ষা হিসেবে কুরআনের হাফেজ বানিয়েছেন। বর্তমানে ছেলে রাজ্জাক মুফতি পাস করে মোহাদ্দিসে পড়ালেখা করছে। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়েই চলছে সংসার।
রুহুল আমিন সম্পর্কে স্থানীয় হাফিজুর রহমান বলেন, মানুষের মৃত্যুর পর তার গোসল, কাফন ও দাফনের যে অপরিহার্য বিষয়গুলো রয়েছে। এ বিষয়গুলোর মধ্যে মরদেহের গোসল অন্যতম। মরদেহ গোসল অনেকেই করাতে পারেন না। এক্ষেত্রে আমাদের এলাকায় রুহুল আমিন ভাই দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে নির্ভৃতে এই কাজগুলো করে আসতে দেখছি। ধর্মীয় শিক্ষা থাকায় তিনি এলাকায় কেউ মারা গেলে ছুটে যান। তার এ কাজ দেখে আমরাও অনুপ্রাণিত হই। একই কথা বলেন হাফিজুর রহমান খোকন নামের আরেক স্থানীয় ব্যক্তি। তিনি বলেন, রুহুল ভাই আমাদের কয়েকজনকে কীভাবে মুর্দার গোসল করাতে হয়, তা শিখিয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্য শাহজাহান মিয়া বলেন, এলাকায় রুহুল আমিন খুব নিবেদিত মানুষ। এলাকায় কেউ মারা গেলে তিনি সেখানে পৌঁছে যান। মৃত ব্যক্তির গোসল করান। তার এই গুণ আমাদের খুব মুগ্ধ করে। অনেকে মৃত ব্যক্তির গোসল করাতে পারেন না। কিন্তু রুহুল আমিন ভাই নিজে দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করে দেন কোনো স্বার্থ ছাড়াই।
এমএএস