বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়েতে পাঁচ কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা

দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। উচ্চগতির কারণে প্রতিনিয়তই এ পথে ঘটছে দুর্ঘটনা।
এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে হাইওয়ে পুলিশের সাথে কথা হয়। মূলত পাঁচ কারণে এখানে দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানায় পুলিশ। অতিরিক্ত গতি, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অদক্ষ চালক, যানবাহনের প্রতিযোগিতা এবং আইন অমান্য করা।
পুলিশ জানায়, দ্রুত গতির কারণে প্রতিদিন মামলা ও জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। তারপরও গাড়ির গতি কমানো যাচ্ছে না। গত জুনে এক্সপ্রেসওয়েতে বিভিন্ন অপরাধের কারণে নিয়মিত মামলা হয়েছে ৩৪টি। এছাড়া কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই মামলা করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিদিন গড়ে শতাধিক যানবাহনকে জরিমানা করা হচ্ছে। যার অর্ধেকেরও বেশি অতিরিক্ত গতির কারণে।
হাইওয়ে পুলিশ জানায়, ফিটনেস না থাকার ফলে অনেক সময় গাড়ির চাকা ফেটে দুর্ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় চলন্ত গাড়ির চাকা ফেটে গিয়ে চালক নিয়ন্ত্রণ হারায়। তখন রোলিং এ বারি খায় কিংবা খাদে পরে গাড়িতে আগুন ধরে যায়। এজন্য দেখা যায় মুখোমুখি সংঘর্ষ বা অন্যান্য দুর্ঘটনার চেয়ে চাকা ফেটে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেশি। এছাড়াও যত্রতত্রভাবে পথচারীদের এক্সপ্রেসওয়ে পার হতে গিয়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।

গত ২৪ জুন বেলা ১১টার দিকে এক্সপ্রেসওয়ের মালিগ্রাম উড়াল সড়কে একটি অ্যাম্বুলেন্সের সামনের চাকা ফেটে পাশের রেলিং এ বারি খেয়ে আগুন ধরে যায়। এ ঘটনায় একই পরিবারের সাতজন নিহত হয়। এর আগে গত ১৯ মার্চ শিবচরে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের রেলিং ভেঙে নিচে পড়ে গেলে ১৯ জন নিহত হন। ১৭ জানুয়ারি এক্সপ্রেসওয়ের নাওডোবায় ৬ জন এবং ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর সলিলদিয়ায় নিহত হন ৪ জন।
এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার যাত্রাবাড়ি থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের। এর মধ্যে যাত্রবাড়ি থেকে পদ্মা সেতু পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এবং জাজিরা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২৩ কিলোমিটার।
এই পথে গত এক বছরে ২৬২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৯৪ জন। এর মধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া অংশে ২১১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ২৬ জন। জাজিরা-ভাঙ্গা অংশে ৫১টি দুর্ঘটনায় নিহত হন ৬৮ জন। দুর্ঘটনার সংখ্যা জাজিরা- ভাঙ্গা অংশে কম হলেও এখানে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই এক্সপ্রেসওয়েতে বিভিন্ন অপরাধের কারণে ৩৯ হাজার ৪১৭টি মামলায় মোট ১৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর অপরাধে জাজিরা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অংশে মামলা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৮৭টি।

হাইওয়ে পুলিশ জানায়, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ের একপাশ থেকে অন্য পাশে পার হওয়ার জন্য ২১টি পদচারী সেতু রয়েছে। নীচ দিয়ে মানুষের পারাপার ঠেকাতে মহাসড়কের দুই পাশে ৩ ফুট উঁচু স্টিলের রেলিং রয়েছে। তবে স্টিলের ওই রেলিং টপকে অনায়াসে প্রতিনিয়ত সড়ক পার হচ্ছেন পথচারীরা।
ফরিদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. ইমরান খান বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে দেশের অন্যান্য রাস্তার চেয়ে প্রশস্ত হওয়ায় অনেকটা ফাঁকা থাকে। এতে চালকরা অতি আত্মবিশ্বাসে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান। গতি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ফরিদপুর থেকে ঢাকাগামী গোল্ডেন লাইন পরিবহনের সুপারভাইজার মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৮) বলেন, চালকরা অনেক সময় ধীরে সুস্থেই গাড়ি চালাতে চান। কিন্তু যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া থাকে। তাছাড়া যে গাড়ির গতি বেশি সে গাড়িতে যাত্রী চড়ে বেশি। এসব কারণে দ্রুত চালানোর একটা প্রতিযোগিতা চলে।
ফরিদপুরের নগরকান্দা পৌরসভার মিরাকান্দা মহল্লার বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজুল আবেদীন (২৪) এই পথে যাতায়াত করেন। তার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, আমরা যেসব বাসে আসি সেগুলো দেখা যায় পদ্মাসেতু পার হওয়ার পর থেকেই লোকাল বাস হয়ে যায়। পথে স্টপেজ ছাড়া যাত্রী উঠানামা করায়। ফলে পেছন থেকে উচ্চগতিতে আসা আরেকটি গাড়ির সাথে সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ফরিদপুর নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক পান্না বালা বলেন, লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি এবং মোটরসাইকেল চলার জন্য দুর্ঘটনা বাড়ছে। পরিবহণ মালিকরা লাইসেন্সবিহীন চালকদের দিয়ে গাড়ি চালান। পাশাপাশি আট ঘণ্টার জায়গায় দিনে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতে বাধ্য করা হয়। এসব ক্ষেত্রে বিআরটিএ ও পুলিশের নজরদারি জরুরি। স্পিড ক্যামেরা স্থাপন করে মনিটরিং এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ভাবে জরিমানা না করা গেলেও পরে শনাক্ত করে জরিমানার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি সামাজিব সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।

ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশ সুপার (মাদারীপুর রিজিওন) মাহবুবুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসব তদারকির জন্য প্রতিটি হাইওয়ে থানায় জনবল ৬০ জন, তিনটি গাড়ি ও একটি অ্যাম্বুলেন্স থাকা জরুরি। কিন্তু জনবল আছে অর্ধেক। আর গাড়ি আছে মাত্র একটি। এক্সপ্রেস ওয়েতে আমাদের স্পিডগান আছে মাত্র ৫টি। এদিয়ে তদারকি করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুল আলম বলেন, বিআরটিএর ফিটনেস পরীক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি সড়কের পাশে গতিসীমা বুঝানোর বোর্ড উজ্জল করা, পুলিশের আরও প্রফেশনাল জনবলসহ লজিস্টিক ও টেকনিক্যাল সার্পোট বাড়াতে হবে। অন্তত ৫ কিলোমিটার পর পর স্বয়ংক্রিয় গতি পরিমাপক স্পিড ক্যামেরা এবং সড়কজুড়ে সিসি ক্যামেরা বসাতে হবে। বাস মালিকদের সচেতন হওয়া, প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো এবং দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হলে আপস না করে মামলা ও শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে দুর্ঘটনা কমে যাবে।
তিনি আরও বলেন,সামজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বাড়ানো বড় একটা ব্যাপার। সবাইকে আইন মেনে চলতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার গতির এই সড়কে ১৩০/১৪০ পর্যন্ত গতিতেও গাড়ি চালানো হয়। সর্বোপরি সবার সহযোগিতাই পারে সড়কে মৃত্যু কমিয়ে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে।
জহির হোসেন/এএএ