পড়াশোনার পাশাপাশি চায়ের দোকানে জীবন বদলের স্বপ্ন দেখেন সান-মুন

পরিবারের আর্থিক দুর্দশায় পড়াশোনার পাশাপাশি চায়ের দোকান দিয়ে সংসার চালান মেহেরপুর শহরে বাবা হারা দুই যমজ ভাই সান ও মুন। সান মেহেরপুর সরকারি কলেজে অনার্সে আর মুন পড়েন ডিগ্রিতে।
বাবার অকাল মৃত্যুতে দিশেহারা দুই ভাই মায়ের অনুপ্রেরণায় চায়ের দোকান দিয়েই জীবন বদলানোর স্বপ্ন দেখেন। দুই ভাই চা বিক্রি করে সংসার পরিচালনার পাশাপাশি নিজেদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে সবার কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
জানা গেছে, মেহেরপুর শহরের চক্রপাড়ার আছানুল হকের শহরের কাঁচাবাজারের মধ্যে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান ছিল। তিন ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীকে রেখে ২০১৭ সালে অকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান তিনি। বড় মেয়ের বিয়ে হলেও স্কুলপড়ুয়া জমজ দুই ছেলে সান ও মুনকে নিয়ে সংসার সাগরে ভাসছিলেন আছানুলের স্ত্রী পারুল বেগম। এক চিলতে জমির উপর কোনমতে মাথাগোজার ঠাঁই ছাড়া অন্য কোনো সম্পদ ছিল না তাদের। পাশে দাঁড়ানোর মতো তেমন কোনো আত্মীয়-স্বজনও ছিল না। শেষ পর্যন্ত দুই ছেলেকে দিয়ে চায়ের দোকান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন পারুল বেগম। দুই ছেলে এসএসসি পরীক্ষার আগে থেকেই বাবার চায়ের দোকানের হাল ধরেন। পাশাপাশি মা পারুল হাঁস-মুরগি পালন করে ছেলেদের আয়ের পথে মমতার হাত বাড়িয়ে দেন।

লেখাপড়া শেষ করে তারা অনেক বড় হবে মায়ের এমন অনুপ্রেরণায় দুই ভাই এসএসসি পরীক্ষাও দেয়। পাস করে মেহেরপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়। যমজদের মধ্যে বড় সান ও ছোট মুন। সান মেহেরপুর সরকারি কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে আর মুন একই কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপাড়া করছেন। প্রতিদিন ভোর থেকে চায়ের দোকানে দুই ভাই চা বিক্রির কাজ শুরু করেন। সকাল ১০টা পর্যন্ত কাঁচা বাজারের বিভিন্ন দোকানে চা তৈরি করে পৌঁছে দেন। দোকানে বসেও অনেকে চা পান করে থাকেন। দুই ভাই একে অপরের সহযোগিতার মাধ্যমে দোকান পরিচালনা করে। তাদের আচার আচরণ আর ভদ্রতায় ক্রেতারাও আকৃষ্ট হয়। দোকান শেষ করে ছুটে যায় কলেজে। কলেজের পাঠদান শেষ হলেই আবারও দোকান খোলে। এভাবে স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলেছে যমজ দুই ভাই।
তাদের মা পারুল বলেন, এত কষ্টের পরেও সন্তানরা লেখাপাড়া করছে এটাই আমার গর্ব। লেখাপড়া শেষ করে তারা ভালো চাকরি করবে ওরা এটাই আমার প্রত্যাশা।
জীবনের গল্প বলতে গিয়ে সান বলেন, বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। মায়ের অনুপ্রেরণায় আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। সংসার চালানো আর লেখাপাড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বাবার চায়ের দোকান বেছে নেই। চায়ের দোকান চালিয়ে লেখাপড়া করা গর্বের বিষয়।
মুন বলেন, ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি আমি একটু বেশি আকৃষ্ট ছিলাম। বড় হয়ে ভালো ক্রিকেটার হওয়ার ইচ্ছে ছিল। বাবার অকাল মৃত্যুতে আমার সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। জীবনের হাল ধরতে চায়ের দোকান চালাতে হচ্ছে। তবুও আশা ছাড়িনি। লেখাপড়া করে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই।
মেহেরপুর জেলার হয়ে অনুর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেট দলে জায়গা পেয়েছিলেন ছোট ভাই মুন। বাবা মারা যাওয়ার পর ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গেলেও জীবন যুদ্ধে হাল ছাড়েনি। বড় ভাই সানের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে চায়ের দোকান চালাচ্ছে সে।
সান-মুন দুই ভাইয়ের সহপাঠীরাও বেশ সহযোগিতা ভাবাপন্ন। তারা সব সময় তাদেরকে সঙ্গ দেয়। ওই চায়ের দোকানে বসেই তারা লেখাপড়া নিয়ে আলোচনা করে। চা দোকানি বন্ধু বলে সান-মুনকে দূরে সরিয়ে দেয়নি তার বন্ধুরা।
সানের বন্ধু রাসেল আহাম্মেদ বলেন, পরিস্থিতিতে অনেকেই বিপদগামী হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দুই ভাইয়ের মানিয়ে নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা প্রশংসার দাবিদার।
মেহেরপুর সরকারি কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল আমিন ধূমকেতু বলেন, তাদের সংগ্রাম নতুন প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয়। শিক্ষক হিসেবে আমি খুব গর্বিত। তাদের মত সংগ্রামী ছাত্রদের ভালো মানুষ হওয়ার আহ্বান জানাই।
আরকে