৫ পুরুষ ধরে অন্ধ একই পরিবারের ৬ বাউল শিল্পী, ভালো নেই তারা

২০০ বছরের অধিক সময় ধরে পরিচিতি পাওয়া একই পরিবারে ৬ অন্ধ বাউল শিল্পী এখন ভালো নেই। বাউল গানের চাহিদা কমে যাওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে বেশ কষ্টে আছেন তারা। পালা গানসহ বাউল শিল্পীদের গানের আসর আর আগের মতো সেভাবে বসে না। আগে যেখান একই দিনে ৪/৫টা বায়না আসতো, সেখানে এখন মাসে দুই-একটার বেশি বায়না হয় না।
তাই আর্থিক দৈনতায় দিন কাটছে এই বাউল পরিবারের। অন্যদিকে একই বাউল পরিবারের ৬ সদস্য অন্ধ হওয়ায় অন্য কোনো জীবিকার মাধ্যমে আয় করতে পারছে না তারা।
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার আউটসাহী ইউনিয়নের মামাদুল গ্রামের একই পরিবারের এই ৬ অন্ধ বাউল শিল্পী এখোন আর ভালো নেই। বংশ পরম্পরায় ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে এই অন্ধ বাউল শিল্পী পরিবারের পূর্ব পুরুষরাও অন্ধ ছিল এবং তারাও বাউল ছিল।
এই বাউল পরিবারে মধ্যে মারফত আলী বয়াতি ছিলেন মুন্সীগঞ্জের নাম করা বাউল শিল্পী। তিনি আধ্যাত্মিক বাউল শিল্পী ছিলেন। ১২০০ এর অধিক গান রচয়িতা এই অন্ধ বাউল শিল্পী প্রায় ২৫ বছর আগে মারা যান। তিনিও জন্মগত অন্ধ ছিলেন। তার বাবা কাদের ফকিরও ছিলেন ওই এলাকার নামকরা বাউল। তিনিও অন্ধ ছিলেন। কাদের বাউল প্রায় ৮০ বছর আগে ১২০ বছর বয়সে মারা গেছেনল। কাদির বাউল মৃত্যুর আগে ৪ ছেলে রেখে মারা যান তারা হলেন জাফর আলী বাউল, মারফত আলী বাউল, সবুজ আলী ও কুদরত আলী।
তাদের সবাই গান করলেও তাদের মধ্যে মারফত আলী বাউল ছিলেন সুনামধন্য একজন বাউল শিল্পী ও অধ্যাতিœক জগতের মহাপুরুষ। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম (৮০) বলেন, আমার স্বামী মারফত আলী বাউল ছিলেন একজন সুনামধন্য বাউল শিল্পী। তার গান টিকিট কেটে মানুষ শুনতো। এক সময় তাদের বাড়িতে মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো। ১০৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
মৃত্যূকালে এই অন্ধ বাউল ৪ ছেলে রেখে মারা যান। তারা হলেন, আমির হোসেন বয়াতি (৬৫) ,আনোয়ার হোসেন বয়াতি (৬৩), মোয়াজ্জেম হোসেন (৫৫) ও নজরুল ইসলাম বয়াতি (৫০)। তাদের মধ্যে বাবা মারফত আলি বয়াতির কাছে গান শিখেছেন ৩ ছেলে আমির হোসেন বয়াতি, আনোয়ার হোসেন বয়াতি ও নজরুল ইসলাম বয়াতি। মোয়াজ্জেম হোসেন তেমন গান করেন না।
অনোয়ার হোসেন বয়াতি এক সময় গান করলেও এখন এ পেশা অনেকটা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে আমির হোসেন বয়াতি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের লিস্টেট বয়াতি শিল্পী। তিনিও অন্ধ তবে ভালো গান করেন। নজরুল ইসলাম বয়াতিও অন্ধ। আমির হোসেন বয়াতির ৩ ছেলেও অন্ধ এবং তারাও বাউল শিল্পী। তারা হলেন, সেন্টু (৪০), মিন্টু (৩৫) ও হৃদয় (৩২)। সেন্টুর বাউলেরও রয়েছে এক ছেলে নাম আব্দুর রহমান (৫)। সেও অন্ধ। তবে বাবা সেন্টু ও দাদা আমির হোসেনের কাছে গানের শিক্ষা নিচ্ছে সে।
বংশপরস্পরায় ২০০ বছর ধরে চার অন্ধ এ বাউলরা হাজারো গান গেয়ে শুনিয়ে যাচ্ছেন মানুষদের।
এ ব্যাপারে আমির হোসেন বয়াতি বলেন, আমার দাদা কাদের ফকির ছিল অন্ধ বাউল, আমার বাবা মারফত আলী বায়াতিও ছিল অন্ধ। আমি আমার বাবার কাছ হতে গান শিখেছি। বাংলাদেশের যত নামকরা বাউল শিল্পী রয়েছে। আমি প্রায় সব শিল্পীর সঙ্গে গান করেছি। আমি বর্তমান সংসদ সদস্য মমতাজ বেগমের সঙ্গে গান করেছি। শিল্পী খালেক দেওয়ান, রজ্জব আলী দেওয়ান, সালাউদ্দিন, আবুল সরকার, ছোট আবুল সরকার, পরেশ দেওয়ানের সঙ্গে গান গেয়েছি। আমি বেতার টেলিভিশনে গান গাই। নারায়ণগঞ্জ ঢাকা অনেক জায়গায় গিয়ে বাবার সঙ্গে গান গাইতাম। সেই সময় থেকে আমি বাবার সঙ্গে পালা গান করি। আগে গানের অনেক চাহিদা ছিল। এক রাতে চার পাঁচ জায়গা থেকে বায়না আসতো। কিন্তু এখন দিনদিন এই জিনিসটা কমে যাচ্ছে। আসলে যে পালা গান সেটা এখন আর নাই।
তিনি আরও বলেন, আমার বাবার ১২০০ গান লেখা ছিল। এক সময় ১২০০ গানই আমার মুখস্ত ছিল। কিন্তু এখন দিন দিনও বুড়া হয়ে যাইতেছি। বাবার অনেক গানই ভুলে গেছি। এখনো বাবার ৬/৭ গান মুখস্ত আছে। তবে বর্তমানের গান আর আগের গান অনেক পার্থক্য। আগের গান বর্তমানে মুরুব্বি টাইপের লোকজন কিছু শুনে। আমি যদি চোখে দেখতাম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী না হইতাম তাহলে এখনো সব সময় গান ধইরা রাখতে পারতাম। অনেক দূর আগায়া যাইতে পারতাম। আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, আমার সচ্ছলতা নাই যন্ত্রপাতি লাগে নানা কিছু লাগে এজন্য আগাইতে পারি নাই।
নজরুল ইসলাম বয়াতি বলেন, প্রথম শিল্পী ছিল আমার দাদা কাদের ফকির। সে অন্ধ শিল্পী ছিল। আমার বাবা মারফত আলি বাউল সে ছিল নামকরা বাউল শিল্পী। আমার বাবার কাছ থেকে আমরা শিক্ষা নিছি। তার কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে গান গাই।
আগে মাসে আমরা ২০টা থেকে ২৫টা বাউল গানের প্রোগ্রাম করতাম। এখন মাসে দুটা প্রোগ্রামও করতে পারি না। আমরা যাতে চলতে পারি সরকার এবং সংস্কৃতি কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি দৃষ্টি রাখবেন। আমরা যদি ঠিকমতো চলাফেরা করতে না পারি, তাহলে প্রাচীন সুরগুলো ভবিষ্যতে আর থাকবে না। বিলীন হয়ে যাবে। ধ্বংস হয়ে যাবে।
এ ব্যাপারে বাউল শিল্পী সেন্টু বলেন, আমার দাদা, দাদার বাবা, চাচারা, আমার বাবা, আমি, আমার দুইভাই সবাই অন্ধ বাউল শিল্পী। আমার ছেলে আব্দুর রহমানও অন্ধ। আমি আমার ছেলেকেও শিল্পী বানাতে চাই। আমার পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।
আরকে