মাদকের থাবায় অপরাধে তারুণ্য

ময়মনসিংহে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিশোর অপরাধ। কিশোররা নিজেদের আধিপত্য দেখানোর জন্য মাদক গ্রহণ করে ফেসবুকে লাইভ করা, মাদকের টাকার জন্য খুন, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় জড়াচ্ছে। এছাড়া মাদকের টাকার জন্য পরিবারগুলোতেও বাড়ছে অশান্তি। মাদকের টাকা না পেয়ে বাবা-মাকে মারধর ও ভরণপোষণ না দেওয়ার ঘটনাতেও থানাগুলোতে মামলা হচ্ছে। মাদকের বিস্তার চললেও সচেতনতামূলক কার্যক্রম তেমন একটা চোখে পড়ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রায়ই অভিযান চালিয়ে মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক উদ্ধার করলেও সমাজে কমছে না মাদকের বিস্তার। ফলে দিনদিন মাদকের দিকে ঝুঁকছে তরুণরা।
মাদকসেবীর সংখ্যা বাড়লেও এ থেকে বেরিয়ে আসতে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা অপ্রতুল। জেলায় মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে মোট ১৭টি। এর মধ্যে দুটি ২০ বেডের, বাকিগুলো ১০ বেডের। তবে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি মাদকসেবী রয়েছে কেন্দ্রগুলোতে। কেন্দ্রগুলোতে অন্তত আড়াই শ মাদকসেবী চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, প্রথমে সিগারেট ও গাঁজা দিয়ে শুরু করলেও ইয়াবা ও হেরোইন গ্রহণের মাত্রা ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ নামক আঠালো বস্তু স্থানীয়ভাবে ‘ড্যান্ডি গাম’ নামে পরিচিত। জুতা মেরামতে ব্যবহারের জন্য এই গামকে মাদক হিসেবে গ্রহণ করছে গরিব শ্রেণির মাদকসেবীরা, একটানা দুই বছর ড্যান্ডি গ্রহণ করলে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় সেবীরা।
চলতি বছরের ২৬ মে এক তরুণকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় ভালুকার কিশোর গ্যাং অনিক গ্রুপের প্রধান রেজওয়ান মাহমুদ অনিককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এছাড়া কিশোর গ্যাংয়ের একটি ভিডিও পায় র্যাব। নিজেরা মাদক গ্রহণ করে উল্লাস করে তা আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভও করে দলটি।
এদিকে গত ২২ এপ্রিল ঈদুল ফিতরের দিন ময়মনসিংহ নগরীতে একজন রিকশাচালক ও একজন ইজিবাইকচালককে খুন করে তিন কিশোর। মাদকের টাকার জন্য কিশোরদের দলটি দুটি হত্যার ঘটনা ঘটায়। তিনজনের মধ্যে দুইজনই নগরীর দুটি স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষার্থী ছিল।
গত ৯ জুন ময়মনসিংহ নগরীর আরকে মিশন রোড এলাকার দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছাত্র মাদকের টাকার জন্য ব্যবসায়ী বাবা-মাকে মারধর শুরু করে। প্রায়ই এমনটি করছিল ওই ছাত্র। একপর্যায়ে পরিবার বাধ্য হয়ে খবর পাঠায় নগরীর আইডিয়া মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। পরে সেখানে তাকে নেওয়া হয় সুস্থ করে তোলার জন্য।
নগরীর পাশাপাশি গ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। জেলার হালুয়াঘাটের একটি গ্রামের ট্রাক ড্রাইভারের নবম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে মাদকের জন্য ঘর থেকে টাকা সরাতে শুরু করে। কোনোভাবেই ছেলেকে ফেরাতে না পারায় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে দিয়েছেন বাবা।
১৩ বছর ধরে ময়মনসিংহ নগরীর মাসকান্দা এলাকায় আইডিয়া মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনা করে আসছেন সাদেকুর রহমান সাদেক। তিনি ঢাকা পোস্টকে জানান, তার প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নেওয়া ১১ জনের মধ্যে তিনজনের বয়স ১৫ এর মধ্যে। তারা বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করে। এসব কিশোররা ইয়াবা ও গাঁজা বেশি গ্রহণ করে।
সাম্প্রতিক সময়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে বলে তিনি জানান।
এদিকে মাদকের বিস্তার রোধে তৎপর রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানে চালিয়ে গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে ফের মাদক ব্যবসা ও সেবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। জানা গেছে, ময়মনসিংহে মূলত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকা থেকে নান্দাইল হয়ে মাদক প্রবেশ করে। ঢাকা থেকে ভালুকা উপজেলা দিয়েও ময়মনসিংহে মাদক আসে। মাদক গ্রহণে ইয়াবা সবার পছন্দের মধ্যে থাকলেও বিত্তবানরা মাদক হিসেবে হেরোইন গ্রহণ করে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে হেরোইন ছড়িয়ে দেওয়া হতো শেরপুর থেকে। চক্রটির দুই নারী সদস্যসহ চারজনকে অবশ্য গত বছরের আগস্টে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। তবে এ অঞ্চলে ব্যবহার হওয়া হেরোইন বেশিরভাগই ভেজাল বলছে সংশ্লিষ্টরা। এতে মাদকসেবীরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জেলা পুলিশের তথ্য বলছে, ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত জেলার ১৪টি থানায় মাদক আইনে প্রায় আড়াই হাজার মামলা হয়েছে। এতে গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাদকসেবী ও বিক্রেতা। এ সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ১৩ কোটি ৫ লাখ ২৫ হাজার ৯৭ টাকার মাদকদ্রব্য। উদ্ধার হওয়া মাদকের মধ্যে রয়েছে বহুল আলোচিত মাদক ‘আইস’, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা, ফেনসিডিল, নেশাজাতীয় ট্যাবলেট ও ইনজেকশন, দেশি-বিদেশি মদসহ বিভিন্ন মাদক। মাদকের প্রবণতা ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানা এলাকায় বেশি। গত দেড় বছরে কোতোয়ালি মডেল থানা এলাকায় পুলিশ ৫ শতাধিক মাদক মামলায় হাজারখানেক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সময় উদ্ধার হওয়া মাদকের মূল্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা।
ময়মনসিংহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, একই সময়ে ২৫১টি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ১৯৭টি নিয়মিত মামলায় আসামি হন পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে ২২০ জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে যাদের সাজা দেওয়া যায় তাদের তাৎক্ষণিক সাজা ও বাকিদের নিয়মিত মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়। অভিযানে বিপুল পরিমাণ হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা, নেশাজাতীয় ইনজেকশন, বিদেশি মদ, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক উদ্ধার করা হয়। র্যাব-১৪ ময়মনসিংহ ২০২২ সালে মাদকসহ ১ হাজার ১৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করে।
জনসচেতনতার ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান
ময়মনসিংহের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজের অধ্যক্ষ ড. এ.কে.এম আবদুর রফিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন, মাদকের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে কথা বলতে হবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সুধীজন, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তি সবাইকে সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। মানসিকভাবে মাদক থেকে ফিরিয়ে আনতে সচেতনতার বিকল্প নেই।
ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক ময়মনসিংহে ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করেছে। সমাজের দুষ্কৃতিকারীরা কিশোরদের ব্যবহার করে বিপথে নিচ্ছে। ৫০০ টাকার জন্য হত্যা করতেও দ্বিধা করে না তরুণরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপরতা বাড়াতে হবে। এদেরকে শাসন করতে আলাদা কোনো ইউনিট গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া মাদক প্রতিরোধে জোরদার সামাজিক আন্দোলন গড়তে হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ময়মনসিংহের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খোরশিদ আলম ঢাকা পোস্টকে জানান, নতুন নতুন মাদক আসায় দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা মাদক গ্রহণ করে তারা সেটি পেতে মরিয়া হয়ে উঠে। পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে টাকা না পেয়ে ছিনতাইয়ে জড়ায়। ১৭ বছর বয়স থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণরাই মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে বেশি জড়িত। এ অঞ্চলে তরুণরা ইয়াবা, হেরোইন ও ইনজেকশন সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে। অন্যান্য মাদকের ব্যবহার কম। ড্যান্ডি গাম যারা মাদক হিসেবে গ্রহণ করে তাদের ব্রেনের সেলগুলো বিকৃত হয়ে যায়। ড্যান্ডি আগে বস্তি এলাকায় গ্রহণ করলেও এখন মধ্যবিত্তরাও এটি গ্রহণ করছে। যারা মাদকে আসক্ত তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এবং নতুন করে কেউ যেন মাদক গ্রহণ না করে সে নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
ময়মনসিংহের কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ওসি মোহাম্মদ শাহ কামাল আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ময়মনসিংহে ইয়াবা, হেরোইন ও ইনজেকশন গ্রহণের প্রবণতা বেশি। তরুণদের মধ্যে গাঁজা সেবন বেশি হয়। এছাড়া টোকাই বা অন্যরা নেশা হিসেবে ড্যান্ডি গাম ব্যবহার করে। মাদকের টাকার কারণে অনেকে ছিনতাইয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মাদকের জন্য মা-বাবাকে মারধর করায় মামলা নিয়ে অভিযুক্তকে জেলে পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাদকে জড়াচ্ছে। হোস্টেল ও মেসগুলোতে বড় ভাইদের দেখে মাদকের দিকে আগ্রহী হয় তরুণরা। সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা হলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. কাউসার আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ইদানীং তরুণদের মধ্যে মাদক গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। মাদকের টাকার জন্য বাবা-মায়ের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করায় আমাদের কাছে নিয়ে আসে। শুধু চিকিৎসা দিয়ে নয় এ ধরনের প্রবণতা রোধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। মাদকের কুফল সম্পর্কে সচেতন করে মাদক থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হবে।
এমজেইউ