বৈষম্য-বঞ্চনা আবু বকরকে দিয়েছে ‘খ্রিস্টের সম্মান’

বেদেপল্লিতে জন্ম বলে সহপাঠীরা সঙ্গে বসতো না। খেলাধুলাসহ বেড়ে ওঠার সময়টাতে পদে পদে হয়েছেন বৈষম্যের শিকার। উঠতে-বসতে যাকে শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটুকথা। একদিকে দারিদ্র্য অন্যদিকে এসব বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হয়েও দমে যাননি তিনি। বরং দারিদ্র্য, বৈষম্য-বঞ্চনাকে জেদে পরিণত করেছিলেন বলেই কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো বৈষম্য-বঞ্চনা আর দারিদ্র্য আবু বকরকে তার সম্প্রদায়ের মধ্যে দিয়েছে খ্রিস্টের সম্মান।
জীবনের এই গল্পটি শরীয়তপুর সদর উপজেলার মুন্সীরহাট বেদেপল্লির আব্দুস ছাত্তার সরদার ও জোসনা বেগম দম্পত্তির ঘরে জন্ম নেওয়া আবু বকরের। আবু বকর বর্তমানে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অঙ্গীভূত সদস্য হিসেবে চাকরি করছেন।
আবু বকরের বেড়ে উঠা মুন্সীরহাট এলাকার কীর্তিনাশা নদীর কোলঘেঁষা উত্তর-পশ্চিম দিকের ছোট্ট চর বেদেপল্লিতে। ১২ বছর আগে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
আবু বকর ঢাকা পোস্টকে জানান, ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল তার। একদিকে দারিদ্র্য ও অন্যদিকে বেদে সম্প্রদায়ের সন্তান হওয়ায় সেভাবে পড়াশোনার সুযোগ ছিল না। পড়াশোনার খরচ যোগাতে কখনো রঙমিস্ত্রী, কখনো খাল-বিল থেকে শাক কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি আবার কখনো মাছ ধরতে হয়েছে তাকে। এসব করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হলেও একপর্য়ায়ে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার ফি ও বই কেনার সামর্থ্য হয়নি আবু বকরের। একদিন বাড়ির পাশের খেয়া পাড় হওয়ার সময় অন্যান্য যাত্রীরা আলোচনা করছিল যে, নির্বাচনে আনসার বাহিনীর হয়ে ডিউটি করলে এক হাজার থেকে এক হাজার পাঁচ শ টাকা পাওয়া যায়। আবু বকরের পরীক্ষার ফি ও বই কিনতেও তখন এক হাজার পাঁচ শ টাকা প্রয়োজন ছিল। যাত্রীদের মুখে শুনে আনসার বাহিনীর ইউনিয়ন দলনেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্বাচনী ডিউটিতে অংশ নেওয়ার সকল যোগ্যতা প্রমাণ করে আবু বকর। কিন্তু ওই দলনেতা যখন জানতে পারেন যে, আবু বকর বেদে সম্প্রদায়ের লোক, তখন কোনো কারণ না দেখিয়েই তাকে ডিউটিতে নিতে অসম্মতি জানান। আবু বকর বুঝে গিয়েছিলেন যে, বেদে সম্প্রদায়ের লোক বলেই তাকে নেওয়া হয়নি নির্বাচনী ডিউটিতে। এই বোধ আবু বকরের মনে প্রচণ্ড আঘাত করে। আঘাতের জেদ চেপে আবু বকর পরিকল্পনা করেন জীবনে যত কষ্টই আসুক না কেন, আনসার বাহিনীতে তাকে চাকরি করতেই হবে।
বেদে সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা আবু বকর আরও জানান, সেদিন পরীক্ষার ফি ও বই কেনার টাকা যোগাতে কঠোর পরিশ্রম করেও পুরো টাকা যোগাতে পারেননি বলে করতে হয়েছিল ঋণ। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করার পর জেলা আনসার ভিডিপির কার্যালয় থেকে প্রথমে ১০ দিনের মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষে ২১ দিনের অস্ত্রসহ প্রশিক্ষণ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। এরপর ২০১৭ সালে গাজীপুরে অবস্থিত আনসার বাহিনীর কার্যালয় হতে ছয় মাসের সাধারণ আনসার প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে পেয়েছিলেন আনসার বাহিনীর স্বপ্নের চাকরি।
জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরেছিলেন বলেই চাকরির পাশাপাশি পড়াশোনা চলমান রেখেছিল আবু বকর। সর্বশেষ একটি বেসরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করলেও সংসার খরচ দিয়ে আর পড়াশোনা হয়নি তার। তবে সুযোগ পেলে আবারও পড়াশোনা করার ইচ্ছে রয়েছে তার। স্কুলজীবনে স্থানীয় এক কবির সান্নিধ্য পেয়ে আবু বকর সাহিত্য, ইতিহাস ও গানের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। নিজে নিজে কবিতা রচনা করে আবৃত্তি ও গান লিখে সুর তোলেন তিনি।
আবু বকরের চাকরি জীবনের প্রথম কর্মস্থল ছিল কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার এলিন ফুড প্রোডাক্ট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানির গার্ড হিসেবে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের কদম রসূল এলাকার সানমুন টেক্সটাইল নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রয়েছেন। কিশোরগঞ্জে চাকরিরত অবস্থায় তামান্না নামের এক মেয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। ফাতেমা নামের তিন বছরের একটি মেয়ে রয়েছে আবু বকরের।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অঙ্গীভূত সদস্য আবু বকর ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্কুলজীবনে বেদে সম্প্রদায়ের লোক বলে সহপাঠীরা আমার সঙ্গে কথা বলত না, খেলায় নিত না। বেদে সম্প্রদায়ের লোক বলে আমাকে নানা ধরনের কটু কথা শুনতে হতো। ছোটবেলায় এসব বিষয়গুলো আমাকে ভীষণ কষ্ট দিত। যদি এসব বিষয় নিয়ে মন খারাপ করে পড়াশোনা বাদ দিতাম তাহলে এতদূর আসতে পারতাম না। বেদে সম্প্রদায়ের সন্তান হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা খুবই কঠিন কাজ। যে বেতন পাই তা দিয়ে বর্তমানে সংসার খরচ বহন করা খুবই কষ্টকর। মা অসুস্থ, বাচ্চার ভরণপোষণ ও অন্তঃসত্তা স্ত্রীর খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আমি আমার সন্তানদের মানুষ করতে চাই। যদি আমার মায়ের চিকিৎসা ও সন্তানদের সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে কেউ সহযোগিতা করতো তাহলে সুন্দর জীবন হতো আমাদের।
আবু বকরের বাবা আব্দুস ছাত্তার সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে সম্প্রদায়ের লোকদের দুইবেলা খাবার জোটে না, তাদের আবার পড়াশোনা! ছেলেকে পড়াশোনা করার সুযোগ দিয়েছি কিন্তু কোনোদিন পড়াশোনার খরচ দিতে পারিনি। নিজের কঠোর পরিশ্রমে আমার ছেলে কলেজ পাস করেছে। আনসার বাহিনীতে চাকরি করে বলে মানুষ আমাকে সম্মান করে। আমি গর্ব করে বলতে পারি আমার সন্তান সরকারের একটি বাহিনীর গর্বিত সদস্য।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর শরীয়তপুর জেলা কমান্ড্যান্ট মো. মইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেদে সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা আবু বকরের পল্লি দেখতে খুব শিগগিরই যাব বলে ভেবেছি। তার পরিবারের খোঁজখবর নিয়ে আসব। আনসার বাহিনী আবু বকরের পাশে থাকবে।
এমজেইউ