মনোবাসনা পূরণে গাজী কালুর দরবারে যান ভক্তরা

দক্ষিণের জেলা বরগুনার নদী বিধৌত একটি উপজেলা আমতলী। এ উপজেলায় রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান। এসবের মধ্যে গাজী কালুর দরবার শরীফ অন্যতম। এটি আমতলীর হলদিয়া ইউনিয়নের টেপুরা গ্রামে অবস্থিত। প্রতিদিন আশপাশের এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু নারী-পুরুষ এখানে সমবেত হন মনোবাসনা পূরণ ও পীরের সান্নিধ্যে এসে পুণ্য লাভের জন্য।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শতবছর আগে আজিজ ফকির ও মালেক ফকির নামে গাজী কালুর দুজন ভক্ত জনমানবহীন স্থানে এই দরবার শরীফ স্থাপন করেন। তখন থেকেই এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের আনাগোনা হতে থাকে। তখন এই জায়গার নাম ছিল সুন্দরবন, পরে কালক্রমে এখানে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে। এখানে রয়েছে গাজী ও কালুর পৃথক দুটি আসন, মনসার ঘর, হযরত খিজির (আঃ) এর পানির কূপ এবং বারো আউলিয়ার আসন। প্রতি বৃহস্পতিবার এই দরবারে সাপ্তাহিক ওরস হয়। এদিন এখানে গান, দোয়া মাহফিল ও তবারক বিতরণ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গাজী কালুর ইতিহাসকে ভক্তরা ধর্মীয় কাহিনী বিশ্বাস করেন। এ কারণেই নানা আশা পূরণ ও পুণ্য লাভের আসায় এই দরবারে ইবাদতে মশগুল থাকেন ভক্ত আশেকানরা। প্রতি বছর ২৯ মাঘ ও ২৯ ফাল্গুন এখানে ওরস মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় মাজার প্রাঙ্গণে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। উৎসব ছাড়াও সারা বছর এখানে আধ্যাত্মিক মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং দর্শনার্থীদের আনাগোনা থাকে।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. মকবুল ও জলিল নামে আজিজ ফকির এবং মালেক ফকিরের দুজন উত্তরসূরি বলেন, শত বছর আগে বরিশালের মালেক ফকির ও বরগুনার পাথরঘাটার আজিজ ফকিরকে স্বপ্নে দেখা দেন গাজী কালু। পরে আমাদের দুই ফকির এখানে এসে দরবার স্থাপন করেন। এরপর থেকেই গাজী কালুর ভক্ত আশেকানরা এখানে আসতে থাকেন।
প্রাচীণ লোকগাথা থেকে জানা যায়, বৈরাট নগরের বাদশাহ সিকান্দারের পুত্রের নাম ছিল গাজী। কালু ছিল বাদশাহর পালকপুত্রের নাম। গাজীর ক্ষমতা ও সিংহাসনের প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। তাই সব কিছু ত্যাগ করে কালুকে সঙ্গে নিয়ে ফকির বেশে সুন্দরবনে চলে যান। সেখানে আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় বনের পশুকে বশ করেন। পরে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণনগরে উপস্থিত হলে রাজকন্যা চম্পাবতীকে দেখে মুগ্ধ হন। কালুর মাধ্যমে রাজার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে রাজা কালুকে বন্দি করেন। ফলে গাজীর সঙ্গে রাজার যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে গাজীর পক্ষে অসংখ্য বাঘ ও পরী এবং রাজার পক্ষে কুমির, হাতি অংশগ্রহণ করে। এ যুদ্ধে রাজা পরাজিত হন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে চম্পাবতীর সঙ্গে গাজীর বিয়ে হয়।
এসবের পাশাপাশি কিছু উপকাহিনীও রয়েছে এতে। ভক্ত আশেকানদের বিশ্বাস গাজী কালুর অলৌকিক সব ক্ষমতা ছিল। তাই তারা এই দুই পীরের সান্নিধ্যে আসতে প্রার্থনা ও মনবাসনা পূরণে তাদের দরবারে মানত করে থাকেন।
বরগুনার আমতলীর গাজী কালুর দরবারে আসা নাজমা আক্তার নামে এক নারী বলেন, আমার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে পীরের দরবারে মানত করেছিলাম। আল্লাহ আমার ইচ্ছে পূরণ করেছে। তাই বাচ্চাকে নিয়ে এসে এখানে গোসল করিয়েছি। পীরের কাছে দোয়া চেয়েছি যাতে আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভালো থাকি।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. মিলন বলেন, আমি এখানে বহু বছর ধরে দোকানদারি করি। দরবারে আসা মানুষজনই আমাদের ক্রেতা। সরকার যদি এই দরবারটির আরও অবকাঠামো উন্নত করতো তাহলে এখানে আরও মানুষ আসত।
মাজারে আসা গাজী কালুর এক ভক্ত আবুল হোসেন বলেন, আমি বহু বছর ধরে এখানে আসি। জিন্দা পীর গাজী কালুর দোয়ায় আল্লাহ যাতে পরকালে পার করে নেন সে জন্যই এখানে এসে প্রার্থনা করি।

মাজারের খাদেম আবদুল গনী খান বলেন, এখানে গাজীর আসন, কালুর আসন, মা মনসার ঘর, হযরত খিজির (আঃ) এর কূপ ও মসজিদ মাদ্রাসা আছে। মানতের টাকা দিয়েই এসব পরিচালিত হয়। প্রতিবছর দুইবার এখানে বড় ওরস হয়। এছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান হয়। এসব কিছু মানতের টাকা ও মালামাল দিয়েই চলে। সরকারি সহায়তা পেলে দরবারটি ভালোভাবে চালানো যেত।
হলদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিন্টু মল্লিক বলেন, সব ধর্মের কাছেই গাজী কালুর কাহিনী সমাদৃত। আমাদের ইউনিয়নে টেপুরা গ্রামে গাজী কালুর দরবার আছে। প্রতিদিন এখানে বহু লোকজন আসে। এটি শুধু আমতলীর নয়, গোটা জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। তাই এখানে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
যেভাবে যাবেন
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কুয়াকাটাগামী বাস ছাড়ে। এসব বাস ৫-৭ ঘণ্টার মধ্যে আমতলী একে স্কুল চৌরাস্তায় নেমে সেখান থেকে মোটরসাইকেল বা ইজিবাইকে সরাসরি গাজী কালুর দরবারে পৌঁছানো যায়। বাসে ঢাকা থেকে আমতলী পর্যন্ত জনপ্রতি ৬০০-৮০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়। আমতলীর একে স্কুল চৌরাস্তা থেকে গাজী কালুর দরবার পর্যন্ত যেতে মোটরসাইকেলে ১৪০-১৬০ টাকা ভাড়া দিতে হবে।
এছাড়া ঢাকা থেকে লঞ্চে বরগুনা এসে সেখান থেকে আমতলী হয়েও গাজী কালুর দরবারে যাওয়া যায়। বরগুনা সদর থেকে আমতলীর গাজী কালুর দরবারের দূরত্ব ৩৬ কিলোমিটার।
আরএআর