দিনভর শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে থমথমে গাজীপুর

বেতন বৃদ্ধির দাবিতে গাজীপুরে সপ্তম দিনের মতো সোমবার (৩০ অক্টোবর) সকাল থেকে পোশাক কারখানার শ্রমিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন। এ সময় পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন শ্রমিকরা। এছাড়াও পুলিশের গাড়ি, পুলিশ বক্স ও একটি পোশাক করাখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। দিনভর শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের পর গাজীপুরে এখন থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে।
এদিকে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের সময় পুলিশের রাবার বুলেট ও লাঠিচার্জে অন্তত অর্ধশতাধিক পোশাক শ্রমিক আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৫ জনকে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পুলিশের গুলিতে এক পোশাকশ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহত ওই শ্রমিকের নাম রাসেল হাওলাদার (২২)। তিনি ঝালকাঠি সদরের বিনাইকাঠি গ্রামের হান্নান হাওলাদারের ছেলে। তিনি গাজীপুর মহানগরীর কলম্বিয়া এলাকার নূর আলমের বাড়ির ভাড়াটিয়া। রাসেল ওই এলাকার এনার্জিপ্যাক ডিজাইন গার্মেন্টসে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে চাকরি করতেন। এছাড়াও সন্ধ্যায় মহানগরীর কোনাবাড়ী থানা এলাকায় এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড নামে পোশাক কারখানায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের দেওয়া আগুনে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। আগুনে পুড়ে যাওয়ায় ওই মরদেহ নারীর নাকি পুরুষের তাৎক্ষণিকভাবে তা নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ, শ্রমিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে সপ্তম দিনের মতো সোমবার সকাল ৯টার দিকে মহানগরীর ভোগড়া বাইপাস এলাকার আশপাশের শ্রমিকরা আন্দোলনে নামেন। তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে যান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেন। এ সময় পুলিশ ভোগড়া বাইপাস মোড়ে এসে শ্রমিকদের মহাসড়ক থেকে সরে যেতে বললে পুলিশকে লক্ষ্য করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন।
পরে শ্রমিকরা মিছিল সহকারে ভোগড়া, বাসন সড়ক হয়ে কলম্বিয়া ও মালেকের বাড়ি পর্যন্ত যান। সেখানে শ্রমিকরা কলম্বিয়া গার্মেন্ট, স্টার লাইট গার্মেন্টস, মিক সোয়েটারসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় হামলা চালান। এ সময় পুলিশ শ্রমিকদের বাধা দিলে শ্রমিকরা ফের পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করেন। পুলিশ শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা গাজীপুর মাদ্রকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি পিকআপে আগুন ধরিয়ে দেন। শ্রমিকরা বিকেল তিনটা পর্যন্ত মহাসড়ক অবরোধ করে রাখায় ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। শ্রমিকরা মহাসড়কে অর্ধশতাধিক যানবাহনে ভাঙচুর চালান বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
আরও পড়ুন
পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত ১৫ জনকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ১৫ জন ভর্তি রয়েছেন। এরা হলেন- পোশাক শ্রমিক মাজেদ (৩৮), অনিক (১৮), ফারজানা (২২), আদুরী (২৫) খাদিজা (২৬), মিতু (৩০), তানিয়া (৩০), মফিজ মুন্সি (৩৯), শাকিল (২৫), হেলেনা (৪৫), সোহেল (৩০) প্রমুখ। আহতদের শরীরের বিভিন্ন অংশে রাবার বুলেটের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহিম হোসেন খান বিকেলে তার কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, নিহত শ্রমিক রাসেল হাওলাদার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেলে তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
অপরদিকে বিকেলে বিক্ষুব্ধ পোশাক শ্রমিকরা মিছিল সহকারে কোনাবাড়ী এলাকার দিকে চলে যান। সেখানে তারা অনন্ত গ্রুপের এবিএম ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে হামলা চালান। একপর্যায়ে শ্রমিকরা কারখানার ফটক ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে নিচ তলায় আগুন ধরিয়ে দেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভান। ওই আগুনে পুড়ে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা যমুনা গ্রুপের একটি ঝুটের গুদামে আগুন দেন। তাৎক্ষণিক ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। সন্ধ্যা ৭টার দিকে শ্রমিকরা কোনাবাড়ী ফ্লাইওভারের পশ্চিম পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পরিত্যাক্ত আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় ওই সড়কে সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা কোনাবাড়ী এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচে একটি পুলিশ বক্সে আগুন ধরিয়ে দেন।
আন্দোলনরত শ্রমিক মো. আলী আহমেদ বলেন, বর্তমান বাজারে সব ধরনের দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লেও আমাদের বেতন বাড়ানো হয়নি। আমাদের মাসে ৮ হাজার টাকার মতো বেতন দেওয়া হয়। সন্তানসহ তিনজনের সংসারে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। বাকি চার হাজার টাকায় মাসের খরচ সন্তানের স্কুলের বেতন পরিশোধ করে সংসার চালানো যায় না। মাস শেষে গ্রামে মায়ের হাতে টাকাও পাঠানো যায় না। তাই আমাদের বেতন সর্বনিম্ন ২৩ হাজার টাকা করার দাবি জানিয়েছি।
ময়মনসিংহগামী ইসলাম পরিবহনের চালক সেলিম মিয়া বলেন, সকালে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রী তুলে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। বোর্ড বাজার পার হওয়ার পরই শ্রমিকরা মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। পুরো গাড়ি ভর্তি যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই বাস থেকে নেমে দাঁড়ান। আবার অনেক যাত্রী গ্লাস আটকে দিয়ে সিটের নিচে মুখ লুকিয়ে বসে থাকেন। হঠাৎ পুলিশ টিয়ারশেল ছোড়া শুরু করলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মোশারফ জানান, ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শ্রমিকরা চলে গেলে দুপুর ২টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
শিহাব খান/আরএআর