চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ১০ ইউপি সদস্যের অনাস্থা
দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগে নিজ ইউপি সদস্যদের তোপের মুখে পড়েছেন ফেনীর ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সেলিম। এ নিয়ে দুই দফায় তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, অসদাচরণ, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ এনে অনাস্থা প্রকাশ করেছেন ইউপির ১০ সদস্য।
জানা গেছে, গত ২৮ নভেম্বর এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন ১০ জন ইউপি সদস্য। এর এক সপ্তাহ না যেতেই ৭ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফায় ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন তারা।
অনাস্থা প্রদানকারী ১০ ইউপি সদস্য হলেন- ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাঈন উদ্দিন মামুন, ২ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ আহাম্মদ প্রকাশ মিয়া, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের রেজাউল করিম তুহিন, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল হাশেম রিপন, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাইফুল ইসলাম গোলাপ, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল হাসেম, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদ মাইনুল হাছান খোকন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের জামাল উদ্দিন, সংরক্ষিত (১, ২ ও ৩) নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রাহেনা আক্তার এবং সংরক্ষিত (৭, ৮ ও ৯) নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সাকিলা সুলতানা তন্নী।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউপি সদস্যদের সঙ্গে কোনো সভা না করে চেয়ারম্যান মো. সেলিম সকল কাজের সিদ্ধান্ত একাই নেন। সরকারের প্রদত্ত সকল প্রকার ভাতা প্রকৃত ভাতাভোগীদের না দিয়ে চেয়ারম্যান নিজের ইচ্ছেমতো তার পছন্দের লোকদের প্রদান করেন। চেয়ারম্যানের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ইউপি সদস্যরা স্ব-স্ব ওয়ার্ডের প্রকৃত প্রতিবন্ধী, বিধবা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বয়স্কদের ভাতা দেওয়ার জন্য সুপারিশ করলেও চেয়ারম্যান তাদের মতামতকে উপেক্ষা করে নিজের পছন্দমতো নামের তালিকা প্রণয়ন করেন। মাতৃত্বকালীন ভাতার জন্য প্রতিজন থেকে তালিকায় নাম দেওয়ার সময় ৫ হাজার টাকা এবং তালিকা অনুমোদন হয়ে ভাতা নেওয়ার সময় ২ হাজার টাকা করে নেন। এ ছাড়া গভীর নলকূপের তালিকা দেওয়ার সময় প্রতিটির জন্য ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে নেন তিনি।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, ফুলগাজী ইউনিয়নের রেলস্টেশনের পূর্বদিকে ফেনী-বিলোনিয়া সড়কের পূর্ব পাশে বনিকপাড়া রাস্তার ওপর পুরাতন কালভার্ট দেখিয়ে নতুন বিল পাস এবং গোসাইপুর গ্রামে ‘চা’ মসজিদের পাশে পুরাতন প্যালাসাইটিং দেখিয়ে নতুন বিল করে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেন চেয়ারম্যান সেলিম।
অভিযোগে ইউপি সদস্যরা উল্লেখ করেন, তিনি (চেয়ারম্যান সেলিম) কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্পে দুর্নীতি করেছেন। কোন প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে ইউপি সদস্যদের কোনরূপ হিসাবনিকাশ প্রদান করেন না। ইউনিয়নের উন্নয়নমূলক কাজে ইউপি সদস্যদের সম্পৃক্ত না করে কমিশন নিয়ে তার পছন্দমতো ব্যক্তিদের কাজ দেন। সরকারের বরাদ্দকৃত ১ শতাংশ প্রকল্পে কাজ কোথায় হয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। টিউবওয়েল, গভীর নলকূপ, ট্রেড লাইসেন্স, গৃহ নির্মাণের নকশা অনুমোদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি করে ইউনিয়নের মানুষদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে অনাস্থা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়।
ইউপি সদস্যরা অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ইউনিয়ন পরিষদের যাবতীয় আয় কুক্ষিগত করে ইউনিয়নের অ্যাকাউন্ট শূন্য করে সদস্যদের ১৭ মাসের বেতন বকেয়া রাখা হয়েছে। বেতন-ভাতার বিষয়ে চেয়ারম্যান সদস্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। দলীয় প্রভাবের কারণে চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে কেউ সাহস করে না বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন ১০ ইউপি সদস্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, ২০২১ সালের নভেম্বরে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মতামতের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে মো. সেলিম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন। তারপর গত ২ বছরের মধ্যে ২০২২ সালের নভেম্বরে উপজেলার আমজাদহাটে বালুর বদলে মাটি দিয়ে সড়ক নির্মাণের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ জুন সেলিম চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছিল।
এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. সেলিমের বিরুদ্ধে ইউপি সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠে। এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে তৎকালীন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ মঞ্জুরুল ইসলামের কাছে অভিযোগ করেন ইউপি সদস্যরা।
একাধিক ইউপি সদস্যের দেওয়া তথ্যমতে, পরিবারে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকায় ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম বাড়তি প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেন। পরিষদের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ইউপি সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয় না করে নিজের ইচ্ছেমতো সিদ্ধান্ত নেন।
সদর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম গোলাপ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এজন্য জনগণ সব সময় আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু বণ্টন প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ও স্বজনপ্রীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। কোনো কার্ড এলে ইউপি চেয়ারম্যান তার অনুকূলে অর্ধেকের বেশি বরাদ্দ রেখে অল্পসংখ্যক আমাদের দেয়।
৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসব অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালকের সঙ্গে গত বছর দেখা করার পর চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠকে একটি মৌখিক সমঝোতা হয়েছিল। কিন্তু তারপর বিভিন্ন বরাদ্দ এলেও আমাদের না ডেকে, সমন্বয় না করে তিনি নিজের মতো করে বণ্টন করেছেন। এ ছাড়া কোনো ধরনের সভার বিষয়েও আমাদের জানানো হয় না।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক বলে দাবি করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ইউপি সদস্যরা বিভিন্ন সময় আমার কাছে অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য এসে ব্যর্থ হয়ে এমন ষড়যন্ত্র করছে।
এ বিষয়ে ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনাস্থা প্রস্তাবের একটি অভিযোগ পেয়েছি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার আলোকে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।
ফেনী স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. আবদুল বাতেন ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সেলিমের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাওয়ার কথা নিশ্চিত করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী অনাস্থা প্রস্তাবের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তারেক চৌধুরী/এমজেইউ