‘আগুন যারাই দিয়া থাকুক, তাদের বিচার চাই’

‘কী দোষ করেছিল আমার বউমা আর ছোট্ট নাতিটি। কেন তাদের আগুনে পুড়ে মরতে হলো। আমি আর আমার দাদা ভাইয়ের সোনা মুখ দেখতে পাইতাম না। দাদা ভাই যাওনের সময় আমারে কইছিল- দাদু যাই। আবার আইবামনে। বউমা কইছিল- মা শরীরের খেয়াল রাইখেন। আর কোনো দিন তাদের ফিরে পাইতাম না। আগুন যারাই দিয়া থাকুক, তাদের বিচার চাই।’
মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) দুপুরে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় ট্রেনে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া নেত্রকোণার দক্ষিণ বিশিউড়া ইউনিয়নের বরুনা গ্রামের নাদিরা আক্তার পপির (৩৫) শাশুড়ি ও শিশু ইয়াসিনের (৩) দাদি বৃদ্ধা শহর বানু। মা-ছেলের মর্মান্তিক এ মৃত্যুর ঘটনায় গ্রামের বাড়িতে চলছে মাতম।
এর আগে মঙ্গলবার ভোরে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়ার এ ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া চারটি মরদেহ সকাল ৭টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ট্রেনের তিনটি বগি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নেত্রকোণা সদর উপজেলার বরুনা গ্রামের আবদুল মজিদের ছেলে মিজানুর রহমান ঢাকার কারওয়ান বাজারে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন। স্ত্রী নাদিরা আক্তার পপি ও দুই সন্তান ফাহিম এবং ইয়াসিন আরাফাতকে নিয়ে কারওয়ান বাজারে বাসা ভাড়া করে থাকেন। গত ১১ ডিসেম্বর স্বামীর বাড়িতে সন্তানদের নিয়ে বেড়াতে আসেন পপি। গত রোববার (১৭ ডিসেম্বর) নেত্রকোণা জেলা শহরের কুরপাড়ে ভাসুর আবদুল কাদিরের বাসায় মিলাদ ছিল। সন্তানদের নিয়ে ভাসুরের বাসায় যান পপি।
আরও পড়ুন
সোমবার রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে করে ঢাকায় স্বামীর কাছে ফিরছিলেন পপি। তাদের আর ফেরা হলো না। আদরের সন্তানসহ দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে পুড়ে মরতে হল তাকে। মঙ্গলবার ভোরে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ সময় মা পপি তিন বছরের ছেলে ইয়াসিনকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। আগুনে মা পপি ও ছেলে ইয়াসিন পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। এ সময় পপির ভাই হাবিবুর রহমান ভাগ্নে ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে রক্ষা পান। মঙ্গলবার সকালে ঘটনার খবর নেত্রকোণার বরুনা গ্রামে পৌঁছলে নিহতের পরিবার এবং এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে।
নিহত পপির বাবা ফজলুল হক, শাশুড়ি শহর বানু, শ্বশুর আবদুল মজিদসহ আত্মীয় স্বজনরা শোকে কাতর হয়ে পড়েন। এ সময় শাশুড়ি শহর বানু ও বাবা ফজলুল হক কান্নায় ভেঙে পড়েন।
নিহত নাদিরা আক্তার পপির বাবা নেত্রকোণার পূর্বধলার আলমপুর গ্রামের ফজলুল হক খবর শুনে মেয়ের বাড়িতে যান। তিনি বলেন, আমি কী অপরাধ করেছিলাম। কি দোষে আমার নিষ্পাপ নাতি ও মেয়েকে আগুনে পুড়ে মরতে হলো। আমি আমার মেয়ে ও নাতিকে আর ফিরে পাব না। যারা আগুন দিছে তাদের বিচার চাই।
জানা গেছে, নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে সোমবার রাত ১১টায় ছেড়ে যাওয়া আন্তঃনগর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে এসে থামলে তখন কিছু যাত্রী সেখান থেকে নেমে যান। এ সময় তাদের পেছনের সিটে থাকা দুই ব্যক্তিও নেমে যান। এরপর পেছনের সিট থেকে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ট্রেনের বগিতে থাকা হাবিবুর রহমান ও ফাহিমসহ অন্য যাত্রীরা নামতে পারলেও ভেতরে আটকা পড়েন ছোট ইয়াসিন ও তার মা নাদিরা আক্তার পপি। তারা কোনোভাবেই ট্রেন থেকে বের হতে পারেননি। পরবর্তীতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাদের মরদেহ বের করেন। নিহত পপি স্বামী-সন্তান নিয়ে তেজগাঁওয়ের তেজতুরি বাজার এলাকায় বসবাস করতেন।
নেত্রকোণা মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম বলেন, ঢাকায় ট্রেনে আগুনের ঘটনায় কয়েকজন মারা গেছে বলে শুনেছি। এ ব্যাপারে কেউ থানায় জানায়নি। আমাদের অবহিত করা হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নেত্রকোণা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানিয়া তাবাসসুম বলেন, নিহতদের পরিবারকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।
আরএআর