ফেনীতে প্রবাসী আয়ে আশার আলো

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈধ পথে বৈদেশিক আয় নিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের মুখেও আশার আলো দেখাচ্ছে ফেনীর প্রবাসী আয়ের প্রবাহ। জেলার বিভিন্ন ব্যাংকের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বর মাস পর্যন্ত বৈধ পথে আসা বৈদেশিক আয় বিগত বছরগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রবাসীদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে নিজের ঘাম জড়ানো অর্থ দেশে পাঠাতে আরও উৎসাহী হবেন তারা, এমনটিই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে জেলাভিত্তিক পর্যালোচনায় নবম স্থানে রয়েছে ফেনী। এ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো ডলারের পরিমাণ ৫৫৫ দশমিক ১ মিলিয়ন। শনিবার (৩০ ডিসেম্বর) দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় প্রবাসী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সভায় এমন তথ্য জানিয়েছেন জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নীহার কান্তি খীসা।
সোনালী ব্যাংক ফেনী প্রিন্সিপাল কার্যালয়ের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, ফেনীতে বৈধ পথে বৈদেশিক আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি বছরের ১১ মাসে ফেনীতে ব্যাংকের ১৭টি শাখার মাধ্যমে ২২০ কোটি টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা পূর্বের তুলনায় বেশি। তবে দেশের ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে রেমিট্যান্সের পরিমাণ কম হয়েছে বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
ইসলামী ব্যাংকের একটি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ফেনী অঞ্চলের ৬টি শাখা ও ৩টি উপশাখার মাধ্যমে ১ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা বৈদেশিক আয় অর্জিত হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে যা ছিল ১ হাজার ৮০ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০২২ সালে জেলায় বৈদেশিক আয়ের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৫৩১ কোটি ২১ লাখ টাকা।
ইসলামী ব্যাংক ফেনী অঞ্চলের এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, চলতি বছরের ১১ মাসেই বৈদেশিক আয়ের পরিমাণ গত বছরের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত জেলার ১৮টি শাখায় ৬৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বৈদেশিক আয় অর্জিত হয়েছে। একই সময়ে যা গত বছর ছিল ২৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। তার মধ্যে ফেনী সদর শীর্ষে রয়েছে। এরপরই রয়েছে ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া উপজেলা।
জানা গেছে, স্বাধীনতার ৫২ বছরেও ফেনীতে গড়ে ওঠেনি বিশেষায়িত কোনো শিল্পাঞ্চল। বিসিক শিল্পনগরীর আওতায় জেলায় দুটি শিল্পাঞ্চল থাকলেও সেখানে ব্যাপক হারে তৈরি হয়নি কর্মসংস্থানের সুযোগ। একসময় ফেনীতে দোস্ত টেক্সটাইল মিল চালু থাকলেও এক দশকের অনেক আগে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। জনসংখ্যা কাঠামোতে দেশের ন্যায় ফেনীতেও কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যার আধিক্য রয়েছে। স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ না হলেও কর্মক্ষম মানুষগুলো বেছে নিচ্ছে প্রবাস জীবন।
বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাজধানীতে ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) ২০২২’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানান, ২০২২ সালে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে হেডকাউন্ট রেট জাতীয় পর্যায়ে হয়েছে ১৮.৭ শতাংশ, পল্লী এলাকায় ২০.৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৪.৭ শতাংশ। ২০১৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩ শতাংশ। ওই সময় এ হার পল্লী এলাকায় ছিল ২৬.৪ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ১৮.৯ শতাংশ। ফলে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৫.৬ শতাংশ।
ফেনীতে এ হার কতটুকু তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও করোনা পরবর্তী সময়ে মানুষের আয় এবং ব্যয়ের সক্ষমতা কমেছে। ভাগ্যোন্নয়নের ক্ষেত্রে শিল্প কারখানা নয় বরং ফেনীর ভাগ্যের দুয়ার খুলেছে প্রবাসী আয়ে।
দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের পক্ষ থেকে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির চেষ্টা, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে আবাসনের ব্যবস্থা, যুব উন্নয়ন ও কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা, ভাতা প্রদানের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা, ভিক্ষুকমুক্ত করা ইত্যাদি সরকারি কার্যক্রমগুলোর অন্যতম।
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ের তথ্যমতে, ফেনী হতে ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৩ লাখ ১৭ হাজার ১২০ জন ব্যক্তি জীবিকার সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তার মধ্যে মহিলা কর্মী রয়েছেন ২৫১ জন। ২০২২ সালে কর্মসূত্রে ফেনী হতে প্রবাসে গেছে ২৬ হাজার ৩৭১ জন।
একই কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২২ হাজার ৩৮৪ জন ব্যক্তি ভাগ্য অন্বেষণে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে কমে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৩৯৯ জনে। ২০১৯ সালে আবার বেড়ে হয় ১৫ হাজার ৬৪২ জনে। ২০২০ সালে করোনার প্রকোপে সর্বনিম্ন ৫ হাজার ২০২ জন ব্যক্তি বিদেশে যান। ২০২১ সালে এসে প্রবাস গমনে আবার মোড় ঘুরে। ওই বছর ১০ হাজার ৭৪৬ জন ব্যক্তি বিভিন্ন দেশে কাজের সন্ধানে দেশত্যাগ করেন। চলতি বছরে নভেম্বর মাস পর্যন্ত বিদেশ গেছেন ১৭ হাজার ৯২১ জন ব্যক্তি, যা গত ৫ বছরে সর্বোচ্চ।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, জেলায় ২০২৩ সালে প্রবাসী কর্মীর পরিবারের ১৪ জন প্রতিবন্ধী সদস্যকে মাসিক ১ হাজার টাকা করে মোট ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা প্রদান করে সরকার। এ ছাড়া চলতি বছর ৯০ জন প্রবাসী কর্মীর মেধাবী সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তির চেক প্রদান করা হয়েছে।
এদিকে ফেনীর প্রবাসীর সংখ্যা অনুযায়ী অর্জিত টাকার পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি হওয়ার কথা বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে বৈধ পথ রেখে কেন হুন্ডি বা অবৈধ পথ বেছে নিচ্ছেন প্রবাসীরা। সেই উত্তরের খোঁজে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে অবস্থান করা ফেনীর ১০ জন প্রবাসীর সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। এ সময় বৈধ পথে টাকা না পাঠিয়ে হুন্ডিতে লেনদেন করার বিষয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে।
ঢাকা পোস্টকে তারা বলেন, প্রবাসীদের বড় একটা অংশের বৈধ কাগজপত্র নেই। এজন্য তারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে পারে না। এ ছাড়া অনেক প্রবাসী প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে। সাপ্তাহিক ছুটি না থাকায় তারা ব্যাংকে আসতে পারেন না। আবার ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করতে বেতনের পরিমাণ উল্লেখ করতে হয়। তাই অতিরিক্ত আয় চাইলেও বৈধ উপায়ে পাঠানো অসম্ভব।
জেলার পরশুরাম উপজেলার মিজানুর রহমান নামের এক সৌদি প্রবাসী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৩ বছর ধরে বেশির ভাগ সময় হুন্ডিতে লেনদেন করছি। কারণ ব্যাংক থেকে হুন্ডিতে রেট বেশি পাওয়া যায়। ব্যাংকের চার্জ বেশি। অন্যদিকে হুন্ডিতে বাকিতেও টাকা পাঠানো যায়, যা অনেক সময় দেশে থাকা পরিবারের বড় উপকার করে।
এদিকে প্রবাসী আয়ের সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে জেলার মানুষের জীবনযাত্রার মানও। তবে দেশের অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে বেকায়দায় আছেন ব্যবসায়ীরা।
ফেনী পৌর হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী স্বপন চন্দ্র শীল ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রবাসী আয় বাড়লেও দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিতে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। বাজারে পণ্যের বাজারদর অস্থিতিশীলতার কারণে ব্যবসায় পরিচালনা করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।
মুহাম্মদ রিফাত নামে শহরের এক বস্ত্র ব্যবসায়ী বলেন, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বাড়লেও বিক্রিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়েনি।
বড় বাজারের ফজলুল হক নামের এক মাংস ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্টকে বলেন, খোলা বাজারে বিক্রি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। তবে দাম নিয়ে ক্রেতার অসন্তোষ রয়েছে।
ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার অর্থনীতিবিদ প্রফেসর তায়বুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের জন্য ইতিবাচক। তবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল না থাকলে প্রবাসীরা বৈধ পথে দেশে টাকা পাঠাতে চান না। এ ছাড়া জেলায় প্রবাসীর সংখ্যাও বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, বৈধ পথে প্রবাসী আয়ে চ্যালেঞ্জ হুন্ডি। এজন্য হুন্ডির সুবিধাগুলো যদি সরকারিভাবেও নিশ্চিত করা যায় বা আরও কিছু প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে বৈধ পথে অর্জিত টাকা পাঠাতে প্রবাসীরা উদ্বুদ্ধ হবে।
এমজেইউ