‘২ কোটি টাকার বিনিময়ে নমিনেশন কিনেছিলেন সংসদ সদস্য রতন’

সুনামগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২ কোটি টাকার বিনিময়ে দলের নমিনেশন কিনেছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুট।
কীভাবে উপজেলা চেয়ারম্যান হতে চাওয়া মোয়াজ্জেম হোসেন টাকার বিনিময়ে নমিনেশন ভাগিয়ে সংসদ সদস্য হয়ে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন সেসব তুলে ধরেন নুরুল হুদা। মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন।
বুধবার (৩ জানুয়ারি) রাতে জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা বাজারে সুনামগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রনজিত সরকারের সমর্থনে জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নুরুল হুদার দেওয়া সেই বক্তব্যের সাড়ে ৬ মিনিটের একটি ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
নুরুল হুদা বলেন, প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচনের (২০০৮) মনোনয়ন পাওয়ার ১৫ দিন আগে মোয়াজ্জেম হোসেন রতন আমার বাসায় গিয়েছিলেন। আমাকে সালাম করে বলেছিলেন, ভাই সাহেব, আমি তো উপজেলা ইলেকশন করবো, উপজেলা চেয়ারম্যান হবো। আপনি আমাকে ধর্মপাশা আওয়ামী লীগের একটা মেম্বারশিপ দেন। আমি তখন জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি, মতিউর রহমান সাহেব তখন ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট। মেম্বারশিপ নেওয়ার জন্য আমার কাছ থেকে একটা প্যাডে দস্তখত নিয়ে যান। এরপর তিনি মতিউর রহমান সাহেবের বাসায় যান, মতিউর রহমান সাহেব উনাকে (মোয়াজ্জেম হোসেন রতন) বাসা থেকে বের করে দেন। উনি দুইদিন পর এসে আমাকে বললেন, ভাইসাহেব আপনি তো পেছনে পড়ে গেছেন। কীভাবে পেছনে পড়লাম? তা জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি তো নমিনেশন নিয়ে আসলাম। আমি জিজ্ঞেস করলে বললেন, আমি ২ কোটি টাকার বিনিময়ে নমিনেশন নিয়ে এসেছি।
নুরুল হুদা আরও বলেন, আমি তখন খোঁজ নিলাম, আসলে ঘটনা সত্য না মিথ্যা। ওনার (মোয়াজ্জেম হোসেন) এক বন্ধু কানাডার নাগরিক। ওনাকে একটা গাড়ি উপহার দিয়ে উনি নমিনেশন নিয়ে এসেছেন। তখন (২০০৮) এই আসনে মনোনয়নের জন্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও সৈয়দ রফিকুল হকের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছিল। নেত্রীও বিরক্ত হয়ে যান ওনাদের প্রতিযোগিতা দেখে। তারপর সারোয়ার সাহেবকে (কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি) নেত্রী বললেন, দেখো কাউকে পাওয়া যায় কি না? সারোয়ার সাহেব বললেন, নেত্রী একজন ইঞ্জিনিয়ারকে আমরা পেয়েছি। ওই এলাকার সবচেয়ে যোগ্য ইঞ্জিনিয়ার ব্যক্তি তিনি। এরপর নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা জানেন উনি কোন পর্যায়ের ইঞ্জিনিয়ার। উনি একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। অথচ উনি ওনার নামের আগে ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ব্যবহার করেন।
তিনি (রতন) আমাকে বললেন, আমি নমিনেশন নিয়ে এসেছি। আমিতো ঐ এলাকার কোনো মানুষকে চিনি না। আপনার সঙ্গে আমি সুনামগঞ্জ যেতে চাই। আপনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। তখন আমি তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান ও সম্পাদক অমল করকে ডেকে পরিচয় করিয়ে দেই। উনি যাওয়ার সময় বললেন, ভাইসাহেব আমার অ্যাকাউন্ট সিজ হয়ে গেছে, আমার কাছে কোনো টাকা নাই। আপনি আমাকে কিছু টাকা সাহায্য করেন, আমি একমাস পরে আপনাকে টাকা দিয়ে দেব। তখন আমি দুই লাখ টাকা উনাকে হাওলাত দিলাম। এরপরে তিনি তাহিরপুরের অনেক মানুষের কাছ থেকে এক লাখ, দুই লাখ, পাঁচ লাখ করে এভাবে লাখ লাখ টাকা কালেকশন করে নির্বাচন করেছেন।
নুরুল হুদা সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, একজন নতুন লোককে পেয়ে মানুষ ভেবেছে এবার এলাকার উন্নয়ন হবে। কিন্তু নির্বাচিত হয়ে উনি কি করলেন? উনি উনার নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করা শুরু করলেন। ধর্মপাশায় উনার তিন-তিনটা বাড়ি, বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায় ওনার বাড়ি আছে, ঢাকায় বিরাট অট্টালিকা আছে, ঢাকা ওনার একটা ফ্ল্যাট এক বউয়ের নামে, আরেকটা ফ্ল্যাট আছে আরেক বউয়ের নামে। একটা ওনার নামে, একটা ওনার ভাইয়ের নামে। কানাডাতেও ওনার বড় স্ত্রীর নামে বাড়ি আছে। আপনার আমার ডেভেলপমেন্টের টাকা। ওনার বাপের টাকা নয়। আপনার আমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে ওনার নিজের উন্নয়ন করেছেন। নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন। আজকে ওনার টাকার কোনো অভাব নেই।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে ভোট দিতে যেতে হবে। ভোট কাস্ট কম হলে আপনাদের এলাকার বেইজ্জতি হবে। আপনারা বিপুল পরিমাণে ভোট কাস্ট করাবেন এবং রনজিত সরকারকে বিজয়ী করবেন।
সভায় প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সিলেট সিটি করপোরশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান। তিনি বলেন, রনজিত সরকার আমার ছোট বেলার বন্ধু। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আমরা একসঙ্গে রাজনীতি করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত শক্তিশালী করতে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে রনজিত সরকারকে বিজয়ী করতে আপনাদের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি। তিনি আপনাদের মুখ উজ্জ্বল করবেন। আমি বিশ্বাস করি সুনামগঞ্জ-১ আসনের ৪টি উপজেলায় নৌকার যে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। নৌকার বিজয় কেউ আটকাতে পারবে না।
জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল মুকিত চৌধুরী সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নোমান বখত পলিন, তাহিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হোসেন খান, সাধারণ সম্পাদক অমল কান্তি কর, ধর্মপাশা উপজেলার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বিলকিস, জামালগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাজী আশরাফ, জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ, সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাংশু দাস মিঠু, সুনামগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুবের আহমেদ অপু, সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হাসান, সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি দীপঙ্কর কান্তি দে প্রমুখ।
সোহানুর রহমান সোহান/এএএ