ভোট চাইতে এলে এর জবাব দেওয়া হবে

এলাকার দিনমজুর, ভ্যানচালক, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ দান করেছেন টাকা, কেউ দিয়েছেন ইট, বালু, খোয়া, সিমেন্ট; কেউবা দিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম। এভাবে দুই মাস ধরে জমানো অর্থে এলাকাবাসীর উদ্যোগে দুটি কালভার্টের একটি সংস্কার করে, আরেকটি সংস্কারের জন্য টাকা সঞ্চয় করা শুরু করেছেন স্থানীয় যুবকরা। তাদের এমন উদ্যোগ এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে।
বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) দুপুর থেকে শনিবার (১৭ এপ্রিল) গভীর রাত পর্যন্ত তিন দিন ধরে এই কালভার্টটি নির্মাণে প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন পাবনা সদর উপজেলার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের কামার ডাঙ্গা-ফারাদপুর গ্রামের বাসিন্দারা।
গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষেরা বলছেন, সামনের ইউপি নির্বাচনে ভোট চাইতে এলে এর জবাব দেওয়া হবে। জনগণের উপকারে না এলে এসব জনপ্রতিনিধির কোনো প্রয়োজন মনে করেন না তারা।
গ্রামের পাকা রাস্তার খালের ওপর সংযোগ সড়কে নির্মাণ করা হয় কালভার্ট দুটি। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে বালুবাহী ড্রাম ট্রাকসহ বড় বড় গাড়ি চলাচল করায় কালভার্ট দুটি ভেঙে দেবে মাটিতে মিশে যায়। এলাকার জনপ্রিতিনিদের বারবার বিষয়টি বলার পরও তারা সংস্কারের উদ্যোগ নেননি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
শনিবার (১৭ এপ্রিল) রাতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, দুবলিয়া-ফারাদপুর-কামারডাঙ্গা হয়ে কুচিয়ামোড়া সড়কের কালভার্ট সংস্কার কাজে ব্যস্ত গ্রামবাসীর কিছু যুবক। কেউ রাজমিস্ত্রিদের সহযোগিতা করছেন, কেউ পানি টানছেন, কেউবা বাজার থেকে ভ্যানে করে বালু-সিমেন্ট আনতে গেছে। তিন দিন ধরে কাজ করে এটি সম্পন্ন করা হয়।

গ্রামবাসীরা জানান, সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের দুবলিয়া বাজার পুলিশ ফাঁড়ির রোড দিয়ে ফারাদপুর-কামারডাঙ্গাসহ প্রায় ১০ গ্রামের মানুষ এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। ওই রাস্তার দুই পাশে হাজারো বিঘা ফসলি জমি রয়েছে। প্রতিদিন এই রোড দিয়ে ভ্যানগাড়ি, করিমন, নছিমনে করে হাজার হাজার মণ রবি শষ্য হাটবাজারে নেওয়া হয়। রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গাড়ি রাতদিন এদিক দিয়ে যাতায়াত করে। কালভার্ট দুটি ভেঙে পড়ায় এখান দিয়ে যান চলাচল প্রায় এক মাস বন্ধ ছিল। ঠিকাদারদের অনিয়ম ও দুর্নীতি করার কারণেই এত দ্রুত কালভার্ট দুটি ভেঙে গেছে বলে মনে করেন তারা।
এলজিইডি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, দুবলিয়া থেকে ফারাদপুর-কামারডাঙ্গা গ্রামে মাটির রাস্তার ওপর দুটি মিনি কালভার্ট একটি ২০০১ সালে অন্যটি ২০১৬ সালে নির্মাণ করে উপজেলা প্রকৌশল অফিস (এলজিইডি)। এরপর ২০২০ সালের শেষের দিকে এলাকার প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা মেরামত করে তারা।
২০১৯ সালে কামারডাঙ্গা শাখারিপাড়া ভায়া সড়কের প্রায় পাঁচ কিলোমিটা নতুন সংযোগের রাস্তা তৈরি করা হয়, রাস্তাটি করতে প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ হয় এলজিইডির। এলাকার রাস্তা নির্মাণের সময় অনিয়ম করায় কয়েকবার কাজ বন্ধ করে দিয়ে সর্বশেষ একটু মানসম্মত কাজ বুঝিয়ে নেয় এলাকাবাসী। পরে চলতি বছরের জানুযারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দুটি কালভার্টই ভেঙে পড়ে যায়।
গ্রামবাসী জানান, কালভার্ট দুটি ভেঙে দেবে যাওয়ার পরই ইউনিয়ন পরিষদ, এলজিইডি অফিসসহ বিভিন্ন দফতরে ধরনা দিয়েও কোনো সমাধান পায়নি। সংস্কারের জন্য স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছে গিয়ে কিছু টাকা চেয়েও আমরা পাইনি। এরপরও আমরা তাদের প্রতি চেয়ে ছিলাম যেন কালভার্ট দুটি সংস্কার করে দেন। মাঝে কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটে। যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমরা বাধ্য হয়ে টাকা তুলে একটি কালভার্ট সংস্কার করলাম। আরেকটা সংস্কার করার জন্য টাকা জোগাড় করতেছি।
স্বেচ্ছাসেবী মমিন হোসেন শেখ জানান, দুটি কালভার্ট সংস্কার কাজ শেষ করতে লক্ষাধিক টাকা খরচ হবে। এখন আপাতত চলাচলের জন্য একটি সংস্কার করছি, সামনে আরেকটি সংস্কার কাজের উদ্যোগ নেওয়া হবে। গ্রামের মানুষ এক হয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী এই টাকা চাঁদা দিয়েছেন। যারা অর্থ দিতে পারেননি, তারা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন। আমরা নিজেরাই কাজটি করে আনন্দ উপভোগ করছি।
এক তরুণ মো. সেলিম রেজা বলেন, ভ্যানচালক, করিমনের ড্রাইভার ও গ্রামের লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা তুলে নিজেদের উদ্যোগে কালভার্টটি সংস্কার করা হলো। অনেকবার জনপ্রতিনিধিদের কাছে গিয়েছি। তারা আমাদের পাত্তা দেয় নাই। এখন আর তাদের দরকার নেই। সামনে টাকা হলে পাশের আরেকটি কালভার্ট ও সংস্কার করব ইনশা আল্লাহ। তিনি আরও বলেন, সামনে বর্ষা মৌসুম, পাশের কালভার্টটি সংস্কার করা না হয়, তাহলে পাকা রাস্তার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। অতি দ্রুত সংস্কার করা দরকার।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য বিলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদে বারবার আলোচনা করেছি, এটা নিয়ে মিটিং হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে সর্বাত্মক লকডাউন হওয়ায় কাজটি করার সুযোগ হয়নি। তবে কর্তৃপক্ষ কয়েকবার স্থান পরিদর্শন করেছে কালভার্ট সংস্কার করার জন্য।

সাদুল্লাপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস মুন্সী ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুবলিয়া পুলিশ ফাঁড়ির রোড দিয়ে কুচিয়ামোড়া ভায়া সংযোগ সড়কের কালভার্ট দুটি সংস্কার করা খুবই প্রয়োজন ছিল। কালভার্ট সংস্কারের জন্য কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েছি, উপজেলা এলজিইডির কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছি, তারা স্থান পরিদর্শন ও জায়গা মাপ দিয়েছে সংস্কার করার জন্য। কিন্তু সম্প্রতি লকডাউন হওয়ায় সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। তবে অচিরেই কালভার্ট দুটির সংস্কারে কাজ শুরু করা হবে।
উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী (এলজিইডি) আজিজুর রহমান ঢাকা পোস্টেকে বলেন, কালভার্ট দুটির জন্য স্থানীয়দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে জায়গা পরিদর্শন ও সঠিক মাপ দেওয়া হয়েছে। আশা করি অচিরেই কাজ শুরু করতে পারব। এলাকাবাসীকে একটু ধৈর্য ধরতে আহ্বান জানান তিনি।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। ভেঙে যাওয়া কালভার্ট গ্রামবাসী উদ্যোগে নির্মাণ হওয়া দুঃখজনক। বিষয়টি খোজঁ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এসব কাজ ইউপি চেযারম্যানদের। তারা যদি আমাদের অবগত করেন, তাহলে বিষয়টি এলজিইডি অফিসের মাধ্যমে সমাধান করা অতি সহজ হয়।
রাকিব হাসনাত/এনএ