রোগী বাঁচবে না জেনে কৌশলী হন ওঝারা

রাত ৯টা, ঘুটঘুটে অন্ধকার। ক্যানেলের পাশ ধরে গ্রামের মেঠোপথ। এর চারপাশে ফসলি জমি। আছে ঝোপঝাড় আর ডোবা-পুকুর। সেই পথ ধরে বাইসাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন আব্দুল মতিন, সঙ্গে গ্রামের এক ছোট ছেলে। পথিমধ্যে প্রস্রাব করতে সাইকেল থেকে নেমে ক্যানেলের পাশে যান। তখনই আচমকা তার পায়ে ছোবল দেয় সাপ। ওই রাতেই আব্দুল মতিনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। অ্যান্টিভেনমের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।
সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে প্রায় ১২ বছর আগে কীভাবে সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই কথা জানিয়েছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব আব্দুল মতিন। বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর চিকিৎসার এ যুগে সাপের কামড়ে কারও মৃত্যুর কথা শুনলে হতাশ হন তিনি। আব্দুল মতিন বিশ্বাস করেন ওঝা বা কবিরাজের ঝাড়ফুঁকে সাপে কাটা রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়।
রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের কাজিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মতিন, পেশায় মুদি দোকানদার। বাড়ির সঙ্গেই তার দোকানঘর। সেখানে বসেই বিক্রির পাশাপাশি গ্রামের মানুষের সঙ্গে সুখ-দুঃখের গল্প করেন তিনি।
ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে আব্দুল মতিন শুনিয়েছেন তার গ্রামের মানুষ সাপের কামড়ে কেন আগে ওঝা বা কবিরাজের চিকিৎসা নেন। এর জন্য সচেতনতা ও শিক্ষার অভাব এবং দরিদ্রতাকে দুষছেন তিনি।
সাপে কাটা রোগীদের কথা
বদরগঞ্জের মধুপুর ইউনিয়নে উন্নয়নের ছোঁয়ায় হাটবাজারে কিছু পরিবর্তন এসেছে। অবকাঠামো উন্নয়নও চোখে পড়ার মতো। তবে হারিয়ে যায়নি গ্রামীণ ঐতিহ্য। এখনো গ্রামের কোথাও মেঠোপথ, দিগন্তজোড়া মাঠের পর মাঠ আর গাছগাছালি ভরা প্রকৃতিতে আবৃত রয়েছে গ্রামটি। নজর কাড়বে মাটির ঘর। কমতি নেই পুকুর, ডোবা-খালের।
এই ইউনিয়নের কাজিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মতিন। সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বদরগঞ্জের হাট থেকে রাতে সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সঙ্গে গ্রামের এক ছেলেও ছিল। ক্যানেলের সরু রাস্তা ধরে আসার পথে প্রকৃতির চাপ দেয়। সাইকেলটা ওই ছেলেকে দিয়ে প্রস্রাব করে ফেরার পথে হঠাৎ অন্ধকারে একটি সাপ ফণা তুলে পায়ে ছোবল দেয়। দ্বিতীয়বার ছোবল দেওয়ার চেষ্টা করে পারেনি।
আব্দুল মতিন আরও বলেন, সাপ কামড়ানোর পর আর দেরি না করে নিকটতম আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে আগে ক্ষত স্থানের উপরে গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধেছিলাম, যাতে করে সাপের বিষ সারা শরীরে ছড়িয়ে না পড়ে। ততক্ষণে গ্রামের লোকজন কবিরাজ ডেকে আনে। কিন্তু আমি ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাই। সেখান থেকে আমাকে দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই রাতেই মাইক্রোবাস ভাড়া করে আমাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হয়। সেখানে নিয়ে আমাকে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হলে সুস্থ হই।
একই গ্রামের যুবক দর্জি ওবায়দুল হক। কয়েক মাস আগে সাপের কামড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামের এক ওঝার কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে এখন তিনি সুস্থ আছেন।
কখন ও কীভাবে সাপে কেটেছে তার উত্তরে ওবায়দুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, বর্ষার সময় মাছ ধরতে রাতে নিথুয়া পাথারে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার পায়ে সাপ ছোবল দেয়। সঙ্গে সঙ্গে লোকজন আমাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এরপর আমাকে পকিহানা গ্রামের এক ওঝার কাছে নিয়ে গেলে সেখানে ঝাড়ফুঁক করার পর থেকে আমি অনেকটা ভালো আছি।
ওঝার চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে এই যুবক ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাকে কোন ধরনের সাপ কামড় দিয়েছিল, তা আমি জানি না। হয়ত বিষধর সাপ ছিল না। এ কারণে আমার তেমন ক্ষতি হয়নি।
গ্রামের সাধারণ মানুষ কী বলছেন
কাজীপাড়া গ্রামের কৃষক রওশন আলী বলেন, আগে সাপ কামড় দিলে মানুষ দৌড়ে ওঝার বাড়িতে যেত। আর এখন আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ থাকায় মেডিকেলে ছুটে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সচেতন হচ্ছে। কিছু দিন আগেও একজন সাপের কামড়ে মারা গেছে। এর জন্য ওই পরিবারই দায়ী। তারা রোগীকে মেডিকেলে নেওয়ার আগে ওঝার কাছে নিয়ে ঝাড়ফুঁক করে সময় নষ্ট করেছে। পরে ওঝার পরামর্শে মেডিকেলে নেওয়ার পথে রোগীর মৃত্যু হয়।
একই গ্রামের মজিতন নেছা ঢাকা পোস্টকে জানান, পার্শ্ববর্তী ধর্মপুর গ্রামে মাসখানেক আগে এক সাপুড়ে মারা গেছেন। ওই ব্যক্তির খুব সাহস ছিল। এজন্য সাপ ধরতে ভয় করতেন না। কিন্তু এবার সাপ ধরতে গিয়ে সাপের কামড়ে তার মৃত্যু হয়েছে। এর জন্য ওঝার ঝাড়ফুঁক আর পরিবারের অবহেলাকে দুষছেন মজিতন।
গ্রামের বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। তাদের একজন ষাটোর্ধ্ব সুলতান মিয়া। এখন থেকে ১৫-২০ বছর আগে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু দেখেছেন তিনি। তার গ্রামে কতজনকে সাপে কেটেছে, আর ক’জনের মৃত্যু হয়েছে, তার হিসাব জানা নেই তার। এখন বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থার কাছে ওঝা বা কবিরাজনির্ভর চিকিৎসার প্রতি মানুষের আস্থা নেই বলে মনে করেন ক্ষুদ্র এই ব্যবসায়ী।
ঢাকা পোস্টকে সুলতান মিয়া বলেন, বিষাক্ত সাপ কামড় দিলে ওঝার ঝাড়ফুঁক দিয়ে কোনো কাজ হবে না। রোগীকে অবশ্যই হাসপাতালে নিতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ভ্যাকসিন দেওয়াসহ চিকিৎসা করাতে হবে। আগে গ্রামের মানুষ বুঝত না, সচেতনতার অভাবে ওঝার কাছে ছুটে যেত। এখন আর সেই দিন নেই। কারণ ওঝারা যে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা আছে, তারই চিকিৎসা করে থাকেন। সিরিয়াস কোনো রোগী গেলে তারা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন।
সাপে কাটা রোগীকে ওঝা বা কবিরাজ কীভাবে চিকিৎসা দেয়, তা বেশ কয়েকবার প্রত্যক্ষ করেছেন ইসমত আরা বেগম। তার মতো গ্রামের অন্য নারীরাও ওঝার চিকিৎসা পদ্ধতির সাক্ষী। তবে এতে রোগী সুস্থ হয় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ইসমত আরা বেগমের।
ঢাকা পোস্টকে এই নারী বলেন, সাপে কাটা রোগীকে কবিরাজ এসে আগে চাল খাওয়ান। চুল এবং চুন দিয়ে সাপে কাটা অংশে ঝাড়ফুঁক করেন। রোগীকে পান খেতে দেয়, এতে শরীরে ব্যথা আছে কি না তা পরীক্ষা করেন। যদি শরীরে ব্যথা থাকে এবং কাটা অংশে সাপের দাঁতের চিহ্ন থাকে তাহলে কবিরাজ বা ওঝা তার মতো করে চিকিৎসা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোগীকে হাসপাতালেই নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা। এর আগে যা করে সেগুলো চোখের ভেলকি ছাড়া কিছুই নয়।
সচেতন মানুষ কী বলছেন
রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করা চাকরিপ্রত্যাশী হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে কথা হয়। মধুপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামের এই যুবক জানালেন বর্ষাকালে তার গ্রামে সাপের উপদ্রব বেড়ে যায়। চার মাস আগেও গ্রামে দুইজন সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর পার্শ্ববর্তী গ্রামে সাপের কামড়ে একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এই যুবকের বিশ্বাস সাপ কামড় দিলে ওঝার চিকিৎসায় রোগীকে সুস্থ করে তোলা সম্ভব নয়। এ কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন তিনি।
ঢাকা পোস্টকে হুমায়ুন কবির বলেন, আমার মনে হয় সাপে কাটা রোগীর শরীর থেকে ওঝারা সাপের বিষ নামাতে পারে না। মানুষ ভ্রান্ত ধারণা থেকে ওঝা বা কবিরাজের কাছে যায়। সত্যিকার অর্থে ওঝারা মানুষের বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা করে। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। এ কারণে আগের মতো সাপের কামড়ে রোগী মৃত্যুর ঘটনা কমে এসেছে।
একই ইউনিয়নের জামুবাড়ি পকিহানা গ্রামের জাকারিয়া হোসাইন আল হাদি একটি সফটওয়্যার ফার্মে কর্মরত আছেন। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগেও আমাদের এলাকায় প্রতি মাসে বিভিন্ন জায়গা থেকে সাপে কাটা রোগীরা ওঝার কাছে চিকিৎসা নিতে আসতেন। এখানে চিকিৎসা নিয়ে সবাই ভালো হত, এমনটাও নয়। তবে গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা না দিয়ে ওঝা ফিরিয়ে দিতেন। এ কারণে ওঝার চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর তেমন কোনো অভিযোগ আমরা জানতে পারিনি। তবে এখন আর আগের মতো সাপে কাটা রোগীরা ওঝার কাছে আসেন না।
তিনি আরও বলেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর চিকিৎসা ব্যবস্থায় আস্থা এবং সাপে কাটা রোগীর জন্য ভ্যাকসিন/ইনজেকশন সহজলভ্য হওয়ায় দিনে দিনে ওঝাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন গ্রামের মানুষজন। এখন ওঝাদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিশ্বাস উঠে গেছে। একই সঙ্গে এই পেশাটাও বিলুপ্তির পথে।
রোগীর মৃত্যুঝুঁকি থাকলে কৌশলী ভূমিকা নেন ওঝা
বদরগঞ্জের জামুবাড়ি পকিহানা গ্রামের দীনোঋশি রায়। প্রায় চার দশক ধরে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা করে আসছেন তিনি। ওঝা হিসেবে উপজেলার মানুষের কাছে বেশ পরিচিত।
ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদককে দীনোঋশি বলেন, আমার ঝাড়ফুঁকে কোনো ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। অনেক মানুষ সুস্থ হয়েছে। আমি উপলক্ষ মাত্র, সবকিছুই উপরওয়ালা (সৃষ্টিকর্তা) করেন। আমার প্রশিক্ষণ আছে কিন্তু লাইসেন্স, চেম্বার-সাইনবোর্ড এসব নেই।
চল্লিশ বছরে সাপে কাটা কতজন মানুষের চিকিৎসা করা হয়েছে, তার কোনো আনুমানিক সংখ্যা জানা নেই দীনোঋশির। তবে শতাধিকেরও বেশি হবে জানিয়ে এই ওঝা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কাছে বদরগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়নের লোকজন আসেন। যারা আমাকে চিনেন তারা সাপে কাটা রোগী নিয়ে আসেন, ঝাড়ফুঁক করে নিয়ে যান। এটা তো বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। তার চিকিৎসায় কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
সাপের কামড়ে কী ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়, এর জবাবে তিনি আরও বলেন, চিকিৎসার তেমন কিছু নেই। আমরা বাঁশের পাতা এবং নিমগাছের পাতা দিয়ে ঝাড়ফুঁক করে থাকি। আমার সঙ্গে আরও দুইজন আছে। এক থেকে দেড় ঘণ্টা ধরে আমরা চিকিৎসা (ঝাড়ফুঁক) করি। এতে রোগী নিজেই বুঝতে পারবে তার উপকার হচ্ছে কি না।
গরিব মানুষজনই বেশি ওঝাদের কাছে আসেন, এমনটা দাবি করে দীনোঋশি বলেন, যার টাকা কম, অভাব আছে তাদের কেউ সাপের কামড়ে অসুস্থ হলে আমার কাছে আসে। আমাকে মানুষ খুশি হয়ে যা দেয়, তাই নিই। আমার কোনো চাহিদা নেই। তবে এখন আর আগের মতো সাপে কাটা রোগী আসে না, বেশির ভাগ মানুষ মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে যায়।
ওঝা হিসেবে নিজের চিকিৎসাব্যবস্থাকে সঠিক দাবি করেন দীনোঋশি। তবে বিষধর সাপ কাটলে তিনি ঝুঁকি না নিয়ে রোগীকে মেডিকেলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ হিসেবে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মানুষের বিশ্বাস যাতে নষ্ট না হয়, সেটাও তো আমাকে খেয়াল রাখতে হবে। এখন চিকিৎসাব্যবস্থা আধুনিক হয়েছে। যে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা কম, তাকে মেডিকেলে যেতে বলি।
একই উপজেলার ৯ নম্বর দামোদরপুর ইউনিয়নের মোস্তফাপুর মণ্ডলপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মোজাম্মেল হক। পেশায় তিনি মাদরাসা শিক্ষক। সাপে কাটা রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসাও দিয়ে থাকেন তিনি। তার চিকিৎসায় রোগী ভালো হয় কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা পোস্টকে মোজাম্মেল হক বলেন, পবিত্র কোরআন থেকে দু-একটি আয়াত পড়ে রোগীর দম (ঝাড়ফুঁক) করে থাকি। এটা বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। তবে কাউকে নিয়মিত চিকিৎসা দিই না। আমি প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি।
জনপ্রতিনিধি ও সংগঠকরা যা বলছেন
বদরগঞ্জের ১০ নম্বর মধুপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নূর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা গ্রামের মানুষের মধ্যে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসার ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। কোথাও যদি কাউকে বিষধর সাপ কামড় দেয় তাহলে অবশ্যই তাকে বিজ্ঞানসম্মত উন্নত চিকিৎসার জন্য সবার আগে হাসপাতালে নিতে হবে। সাপের বিষ যেভাবে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য সাপে কাটা রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রাচীন যুগের ওঝার চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে সাপে কাটা রোগীকে সুস্থ করা বা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ওঝার ঝাড়ফুঁকে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, এটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
দুই মাস আগে তার ইউনিয়নে সাপের কামড়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও তিনি জানান।
অন্যদিকে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের সভাপতি ও মানবাধিকারকর্মী বেলাল আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওঝার ঝাড়ফুঁকে সাপে কাটা রোগীর সঠিক চিকিৎসা হয় না। মানুষ অতীতের ভ্রান্ত ধারণা থেকেই এখনো কোথাও কোথাও ওঝাদের কাছে যায়। কিন্তু এতে রোগীর অবস্থা ক্রমেই খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই ওঝার কাছে গিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি না বাড়িয়ে আগে মেডিকেলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
বিষধর সাপে কাটা রোগীকে প্রথম ১০০ মিনিটের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া গেলে বাঁচানো যায়, এমন রোগীর ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, কাউকে সাপে কাটলে সবার আগে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কাপড় দিয়ে আক্রান্ত স্থানটি বেঁধে ফেলা, কোন হাসপাতালে গেলে দ্রুত সেবা পাওয়া যাবে তা খোঁজ করতে হবে। কোন হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম আছে এবং কোথায় চিকিৎসক প্রস্তুত আছে, সেখানে দ্রুত পৌঁছানোর চেষ্টা করাটা বেশি জরুরি।
কী বলছেন চিকিৎসকরা
প্রতি বছর আমাদের দেশে সাপের কামড়ে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। শহরের চেয়ে গ্রামে সাপের কামড়ে মৃত্যুর ঘটনা বেশি। বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসার অভাব বা চিকিৎসা নিতে বিলম্ব হওয়া। এখনো অনেক গ্রামে কুসংস্কার আছে, সাপে কাটলে ওঝা বা বেদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সাপে কাটলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কীভাবে চিকিৎসা নিতে হবে বা করণীয় কী তা অনেকেই জানেন না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও শুধু সঠিক জ্ঞানের অভাবে মারা যান।
রংপুর জেলার সবকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনম মজুত রাখার উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. ওয়াজেদ আলী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাপে কাটা রোগীদের হাসপাতালে আসা বেড়েছে। আগের মতো মৃত্যুর ঘটনাও নেই। ওঝা বা কবিরাজের চিকিৎসা না নেওয়ার ব্যাপারে আমরা সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে আসছি।
সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, সাপে কাটলে ওঝার কাছে নয়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে হাসপাতালে আসতে হবে। বিষধর সাপে কাটা রোগীকে ওঝার মাধ্যমে চিকিৎসা করালে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
সাপের কামড়ে কী করবেন
আক্রান্ত ব্যক্তিকে বারবার আশ্বস্ত করতে হবে এবং সাহস দিতে হবে যাতে আতঙ্কগ্রস্ত না হয়। নির্বিষ সাপের কামড়েও আতঙ্কিত হয়ে মানসিক আঘাতে মারা যেতে পারে মানুষ। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাপই বিষহীন, অল্প কিছু সাপ বিষধর। আবার বিষধর সাপ পর্যাপ্ত বিষ ঢুকিয়ে দিতে ব্যর্থ হতে পারে। এসব জানানোর মাধ্যমে রোগীকে আশ্বস্ত করা যেতে পারে।
আক্রান্ত অঙ্গ অবশ্যই স্থির রাখতে হবে। হাতে কামড়ালে হাত নাড়ানো যাবে না। পায়ে কামড়ালে হাঁটাচলা করা যাবে না, স্থির হয়ে বসতে হবে। আক্রান্ত অঙ্গ ব্যান্ডেজের সাহায্যে একটু চাপ দিয়ে প্যাঁচাতে হবে। একে প্রেসার ইমোবিলাইজেশন বলে। ব্যান্ডেজ না পাওয়া গেলে গামছা, ওড়না বা এ জাতীয় কিছু ব্যবহার করা যেতে পারে। আক্রান্ত স্থান সাবান দিয়ে আলতোভাবে ধুতে হবে অথবা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতোভাবে মুছতে হবে। ঘড়ি, অলংকার, তাবিজ, তাগা ইত্যাদি পরে থাকলে খুলে ফেলতে হবে।
রোগীকে আধশোয়া অবস্থায় রাখুন। যদি রোগী শ্বাস না নেন তাহলে তাকে মুখে শ্বাস দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। যদি সাপটিকে ইতোমধ্যে মেরেই ফেলেন, তাহলে সেটি হাসপাতালে নিয়ে আসুন। তবে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোভাবেই হাত দিয়ে ধরা যাবে না। কিছু সাপ মরার ভান করে থাকে। তবে সাপ মারতে গিয়ে অযথা সময় নষ্ট করবেন না। যত দ্রুত সম্ভব আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
সাপের কামড়ে যা করবেন না
না জেনে আমরা এমন কিছু কাজ করি, যা রোগীর জন্য ক্ষতিকর হয়ে যায়। তাই এ ব্যাপারে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি। কোনো ধরনের শক্ত বাঁধন/গিঁট দেওয়া যাবে না। সাধারণত দেখা যায়, হাত বা পায়ে কামড় দিলে কামড়ানো জায়গা থেকে ওপরের দিকে দড়ি বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয় যাতে বিষ ছড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। বরং এতে হাত/পায়ে রক্ত প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। ফলে রক্ত প্রবাহের অভাবে টিস্যুতে পচন শুরু হতে পারে।
চিকিৎসার জন্য ওঝার কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কামড়ানোর স্থানে ব্লেড, ছুরি দিয়ে কাটাকুটি করা যাবে না। অনেক মানুষের ধারণা আক্রান্ত স্থানে মুখ লাগিয়ে চুষে বিষ বের করলে রোগী ভালো হয়ে যাবেন। বিষ রক্ত ও লসিকার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যা এভাবে বের করা সম্ভব নয়। কোনো অবস্থাতেই আক্রান্ত স্থানে মুখ দেওয়া যাবে না।
কোনো ভেষজ ওষুধ, লালা, পাথর, উদ্ভিদের বীজ, গোবর, কাদা ইত্যাদি লাগানো যাবে না। কোনো রাসায়নিক পদার্থ লাগানো বা তা দিয়ে সেঁক দেওয়া যাবে না। যদি আক্রান্ত ব্যক্তির গিলতে বা কথা বলতে সমস্যা হয়, বমি, অতিরিক্ত লালা নিঃসরণ, নাসিক কণ্ঠস্বর ইত্যাদি দেখা দেয় তাহলে কিছু খাওয়ানো যাবে না। কিছু খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করা যাবে না। ব্যথার জন্য অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।
এমজেইউ