চিকিৎসকদের জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে

বর্তমান বিশ্বের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল অ্যাডুকেশনের কারিকুলামের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি ফেইজ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট লক্ষে সক্ষমতা অর্জন এবং এর যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যবহারিক দক্ষতা অর্জন করা ও চিকিৎসা প্রদান করা।
মেডিকেল অ্যাডুকেশনের নিয়ম অনুযায়ী সক্ষমতাগুলো হলো “করে দেখানো” অথবা “কার্য সম্পাদন” এর মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট তালিকা গঠন পূর্বক শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজ, ২টি ডেন্টাল কলেজ ও ৮টি ডেন্টাল ইউনিট চলমান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর ৪৮৯৫ জন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয় এবং সমসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ৫ বছরব্যাপী গ্রাজুয়েশন এবং ১ বছর ইন্টার্নশিপ শেষ করে চিকিৎসা পেশায় যোগদান করেন।
চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে জ্ঞান এবং দক্ষতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জ্ঞান পাঠ্য পুস্তকসহ বিভিন্ন উৎস থেকে আহরণ করা যায়। কিন্তু দক্ষতার বিষয়টি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অর্জন করতে হয়। বিশ্ব ব্যবস্থার মানদণ্ড বিবেচনায় চিকিৎসা শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে সমন্বিত চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষে Simulation Lab একটি নতুন সংযোজন যা চিকিৎসকদের জ্ঞান, দক্ষতা ও বাস্তব জীবনে এর প্রয়োগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে শিক্ষার যে ঘাটতি তা Simulation Lab স্থাপনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব। চিকিৎসা শিক্ষা, চিকিৎসা গবেষণা World Federation for Medical Education এবং WHO এর গাইড লাইন অনুযায়ী মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যেসব মানদণ্ড রয়েছে তার মধ্যে চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে Simulation Lab থাকা অন্যতম।

Simulation Lab এর ব্যবহার মূলত চিকিৎসক, নার্স ও প্যারামেডিকদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তরান্বিত করে। যথাযথ ব্যবস্থার মাধ্যমে দক্ষ প্রশিক্ষক এবং আধুনিক স্বনিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত Simulation Lab চিকিৎসাশাস্ত্রে যুগান্তকারী পরির্বতনের সূচনা ইতোমধ্যে অনেক উন্নত বিশের চিকিৎসা শিক্ষায় পরিলক্ষিত হচ্ছে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও মেডিকেল কাউন্সিল দ্বারা স্বীকৃত হয়ে শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে Simulation Lab মেডিকেল কারিকুলামে যুক্ত হয়েছে। উক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় Simulation Lab এর ব্যবহারকে শিক্ষার্থীরা খুবই যুক্তিসংগত বলে ধারণা করে।
প্রায় দুই দশক ধরে কৃত্রিম শিক্ষা সহায়ক (Simulation Lab) এর মাধ্যমে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা হচ্ছে। যদিও দুই দশক আগে এই নতুন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। এর ফলপ্রসূ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় পাঁচ বছর আগে। প্রশিক্ষণদান, শিক্ষাদান এবং পরীক্ষা ব্যবস্থা (Performance Assessment)) এই পদ্ধতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে মালয়েশিয়াতে।
Association of American Medical College (AAMC) ২০১০ সালের একটি গবেষণায় পেয়েছে যে, ১৩৩টি সদস্যভুক্ত মেডিকেল স্কুল এবং ২৬৩টি মেডিকেল কলেজ, যা মোট মেডিকেল স্কুল ও কলেজের ৮০ শতাংশ কৃত্রিম সহায়ক (Simulation) ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত করে। বর্তমানে মেডিকেল কলেজসমূহে ছাত্র-ছাত্রীরা সরাসরি রোগীর মাধ্যমে ব্যবহারিক কার্য সম্পাদন করে জ্ঞানঅর্জন করেন। একজন রোগীকে ছাত্র-ছাত্রী/চিকিৎসক কর্তৃক পরীক্ষার পূর্বে তার অনুমতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক।
এরই ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১৫ এপ্রিল দেশের আটটি মেডিকেল কলেজে সিমুলেশন ল্যাব ও ই-লাইব্রেরি চালু করা হয়। মানিকগঞ্জের কর্ণেল মালেক মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে একযোগে সবগুলো ক্যাম্পাসে (DMC, ShMC, SSMC, CMMC, CMC, CuMC, BSMRMC) সিমুলেশন ল্যাব ও ই-লাইব্রেরি উদ্বোধন করেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বার বার কোনো পরীক্ষা রোগীর শরীরে করলে তা রোগীর জন্য কঠিন শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। উপরন্তু, একজন রোগীর ওপরে শারীরিক পরীক্ষা চিকিৎসক, শিক্ষার্থী ও রোগী সকলের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির সম্মুখীন করে। এসব বিবেচনায় Simulation Lab রোগীর বার বার পর্যবেক্ষণ এবং তদুপরি তার ও চিকিৎসক/শিক্ষার্থীর ঝুঁকির পরিমাণ হ্রাস করে। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা শিক্ষার আহরিত জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে Simulation Lab বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে Simulation Lab স্থাপিত হলে ছাত্র-ছাত্রীরা সরাসরি রোগীর ওপর ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের পূর্বে বিভিন্ন সিমুলেটর এর মাধ্যমে তাদের অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে বাস্তবে অনুধাবন, দর্শন ও পরীবিক্ষণের সুযোগ পাবে।
শিক্ষা কার্যক্রমে Simulation Lab ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গঠনমূলক মূল্যায়ন (Formative Assessment) করা যাবে এবং শিক্ষার্থীরা অর্জিত জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ (Psychomotor Skill) আয়ত্ত্ব করে কর্মজীবনে সুচিকিৎসা প্রদানের কৌশল শিখতে পারবে। শিক্ষার্থীদের পেশাদারিত্বে আস্থা সৃষ্টিসহ সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
দেশে চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মেডিকেল কলেজ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চিকিৎসা শিক্ষায় প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হচ্ছে। সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ও পরিবর্তন আসছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজসমূহে চিকিৎসা শিক্ষার আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্প্রসারণ করা আবশ্যক, চিকিৎসা শিক্ষার ক্ষেত্রে হাতে-কলমে শিক্ষা খুবই জরুরি হলেও যথাযথ সুযোগ না থাকার কারণে অনেক শিক্ষার্থী বাস্তব জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয় না। মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা শিক্ষার বাস্তব জ্ঞান অর্জনে সহায়তাকারী হিসেবে Simulation Lab স্থাপন করা প্রয়োজন।
বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীরা ১ম ও ২য় বর্ষে এনাটমি ব্যবচ্ছেদ (Dissection) অধ্যয়নের জন্য মৃত মানব শরীরের ব্যবহার করে থাকে। এনাটমি ব্যবচ্ছেদ এর জন্য বেওয়ারিশ লাশে ব্যবস্থা করা দুস্কর এবং মৃত্যুর পর শরীর দান করা এদেশে খুব সুপরিচিত নয়। Simulation Lab স্থাপনের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা কৃত্রিমভাবে মানব শরীর ব্যবচ্ছেদ সহজেই শিখতে পারবে।
আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে চিকিৎসা শিক্ষার নব নব উদ্ভাবন প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়ে দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশে জনসংখ্যা অধিক হলেও চিকিৎসা শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে বাস্তব পরীবেক্ষণে রোগীর স্বল্পতা রয়েছে। মেডিকেল শিক্ষার্থীদেরকে চিকিৎসা শিক্ষার বাস্তবিক পরীবিক্ষণের ক্ষেত্রে Simulation Lab গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
একই সময় সকল রোগের রোগী হাসপাতালগুলোতে অবস্থান না করায় মেডিকেল কলেজের সকল শিক্ষার্থী সমভাবে সকল রোগের বিষয়ে হাতে কলমে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সক্ষম হয় না। Simulation Lab এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণের সকল রোগের বিষয় বারবার পরীবিক্ষণ করার সুযোগ থাকায় অধিকতর দক্ষতার সাথে জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয় যা পরবর্তীতে হাতে কলমে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সিমুলেশন ল্যাব শিক্ষার্থীদের স্বনির্ভর শিক্ষা, বার বার অনুশীলন, উদ্দেশ্যপূর্ণ অনুশীলন এবং শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করবে।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন অপারেশনাল প্লানের মাধ্যমে দেশের ১৫টি সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ১টি ডেন্টাল কলেজে Simulation Lab স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। ইতোমধ্যে স্থাপিত Simulation Lab সমূহের মাধ্যমে স্ব-স্ব মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে বাকি সব মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ/ইউনিট সমূহে Simulation Lab স্থাপন করা অতীব জরুরি।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা ও চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়নের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. মোশাররফ হোসেন খন্দকারের মতে, সিমুলেশন ল্যাবের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চিকিৎসকরা আরো বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারবেন। সিমুলেশন ল্যাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে সরাসরি মানব দেহের চিকিৎসা প্রদানের আগে চিকিৎসকরা দক্ষ হয়ে উঠবেন। এতে করে চিকিৎসাকালীন ও চিকিৎসা পরবর্তী অনেক ঝুঁকি হ্রাস পাবে। তারা আশা প্রকাশ করেন দ্রুতই বাংলাদেশের সকল সরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের পাশাপাশি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এই ল্যাব স্থাপন করা হবে।
এমএএস