চালের দাম বৃদ্ধিতে খুচরা থেকে কর্পোরেট সবাই দায়ী : খাদ্যমন্ত্রী
চালের দাম বৃদ্ধির জন্য কর্পোরেট, মিল মালিক থেকে খুচরা ব্যবসায়ী সব পক্ষকে দায়ী করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বগুড়ায় চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে অংশীজনদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন তিনি।
রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বগুড়া জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সভাকক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চালের খুচরা-পাইকারি বিক্রেতা, মিলার-আড়তদার, কর্পোরেট প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় চাল ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা একে অপরের দিকে কাদা ছুড়েছেন। কিন্তু চালের দাম বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ সম্পর্কে অংশীজনরা স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেননি।
আলোচনার শুরুতে খুচরা ব্যবসায়ীর পক্ষে কলোনী বাজার মালিক সমিতির সভাপতি নাহিদ ইসলাম বলেন, খুচরা বাজারে ব্যবসায়ীরা মূলত যেখান থেকে চাল সংগ্রহ করেন, সেখানে দাম বাড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না। বরং মিল ব্যবসায়ী যারা আছেন তারা মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
তার কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বগুড়া জেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহ মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, বগুড়ায় বর্তমানে খুচরা বাজার স্বাভাবিক আছে। দাম যা আছে সেটা আলহামদুলিল্লাহ। মিডিয়াম ও মোটা চাল স্বাভাবিক, তবে চিকন চালটা একটু কম আছে। চিকন চালের দাম বেঁধে দেওয়া ছিল ৬২ টাকা। কিন্তু স্যার আমরা কিনেছি ৬৬-৬৭ টাকায়। আপনাদের মাধ্যমে, মাননীয় মন্ত্রীর মাধ্যমে জানাতে চাই, এটা একটু ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়, এখানে যারা মিল মালিক ভাই
আরও পড়ুন
য়েরা এসেছেন তারা যেন বস্তার গায়ে মিল রেট লিপিবদ্ধ করে দেন।
তবে চাল মজুতের সঙ্গে মিল মালিকরা দায়ী নয়– এমন দাবি তোলেন জেলা হাস্কিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম দুদু। তিনি বলেন, আমরা ধান কিনে চাল করি। ধানের বাজার বেশি থাকলে আমাদের করণীয় থাকে না। আমরা যখন কম দামে চাল প্রস্তুত করি, সেই চাল কোথায় যায়। এ চাল মিল মালিকদের কাছে নিয়ে যায় আড়তদারের কাছে। এখান থেকে অল্প নিয়ে গিয়ে তারা দেখায় অল্প চাল। আমরা যারা চালকল চালাই, তারা কখনো বেশি দাম চাই না, চাইতে পারি না। খোঁজ নিয়ে দেখেন, অনেক মিলার মিল বন্ধ করে দিয়েছে।
আমিনুল ইসলাম দুদুর এমন কথার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক আড়তদার ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চান। তার প্রশ্নের জবাবে আড়তদার ব্যবসায়ী আমজাদ মোল্লা বলেন, আমাদের মজুত করার সুযোগ নেই। আমরা চাল খরিদ করি, বাছাই করি, বাজারে বিক্রি করে দিই। আর সরকারিভাবে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। এজন্য আমাদের ব্যবসা করতে সমস্যা হচ্ছে না।
অটোরাইস মিল মালিক গোলাম কিবরিয়া বাহার বলেন, আমরা অটো মিলাররা ধান কিনি, কিনে চাল প্রস্তুত করি। যখন যে দামে পাই, সেই দামে কেনা হয়। কিন্তু বড় বড় মিল, কোম্পানিরা ধান কেনার সময় যা পায় সব কিনে নেয়। এতে হয় কি, বাজারে হঠাৎ করে ধানের ক্রাইসিস হয়ে যায়। আমরা কখনো সরকারি ক্যাপাসিটির বাইরে মজুত করি না।
তিনি বলেন, এখন কিন্তু কিছু বিষয় বদলেছে। যেমন এখন একজন কৃষক অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওনার একজন ছেলে বিদেশে থাকে। একজন ভালো চাকরি করেন। ওনার ধান্দা থাকে ধানটা স্টক করা। কৃষকের কাছে যদি ধান নাই থাকত, তাহলে প্রতিদিন হাটে কৃষক কেমনে ধান নিয়ে আসতো। কিন্তু আমাদের ধান মজুত রাখার মতো অবস্থা নেই। আমাদের এক টাকা লাভের বেশি কাজ করার সুযোগ নেই। আর যখন প্রডাকশন হয়, তখন সেলও হয়ে যায়। ধরেন আমার ক্যাপাসিটি তিন হাজার টন। চাল উৎপাদন ৩০০ টন হতেই তা বিক্রি হয়ে যায়।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান হিসেবে মেঘনা গ্রুপের বগুড়া মিলের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী কেতাউর রহমান। তিনি দাবি করেন, তাদের মিল এখনো পরীক্ষামূলক অবস্থায় আছে। তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এজন্য এখনো চাল উৎপাদনের কাজ শুরু করা হয়নি।
তবে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বগুড়া সদরের মানিকচক এলাকায় নির্মাণাধীন অবস্থায় মেঘনার রাইস মিল থেকে অবৈধ দুই হাজার টন চাল জব্দ হয়। ওই ঘটনায় একটি মামলাও করেছিল জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তর। মতবিনিময় সভায় সেই মামলার অবস্থা জানতে চান জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম। জবাবে কেতাউর রহমান বলেন, মামলা চলমান আছে।
খুচরা ব্যবসায়ী ও কর্পোরেট মিল উভয়কেই দোষ দেন শাজাহানপুর উপজেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন। তিনি বলেন, এখানে খুচরা ব্যবসায়ী যা বলছে বাজারের সঙ্গে তার কোনো মিল নেই। আমাদের জন্ম থেকে হয়ত আড়তদারের প্রয়োজন আছে। আড়তদার যে দামে চাল বিক্রি করছে হয়ত দুই টাকা, পাঁচ টাকা লাভে বেচে দিচ্ছে। কিন্তু আজ শহরের বখশিবাজারের কাটারি চাল ৭০ টাকা দামে বিক্রি করছে। আর কর্পোরেট মিলাররা কি করছে। আজ বাজারে সুগন্ধী চাল সর্বোচ্চ ১২০ টাকা হতে পারে। কিন্তু এদের চাল কিনতে গেলে ১৪০ টাকা খরচ করতে হবে। আমরা বলতে চাই, আপনারা রাঘববোয়ালদের আটকান। তারা থামলে বাজার এমনি কন্ট্রোল হয়ে যাবে।
এসব পাল্টাপাল্টি দোষ আর বিষোদগারের এক পর্যায়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার চাল ব্যবসায়ীদের শিয়ালের চেয়েও ধূর্ত বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, সাধারণত আমনের সময় সিন্ডিকেট হয় না। সিন্ডিকেট হয় বোরো মৌসুমে। তবে বিগত সময় সেটা ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা, এক টাকা ছিল। কিন্তু এবার সেটা অনেক হয়ে গেছে। জেলাগুলোয় গিয়ে যখন আপনাদের সঙ্গে মুখোমুখি হচ্ছি তখন আসল চেহারা ধরা পড়ছে। আপনারা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করছেন। চালের সিন্ডিকেটের জন্য খুচরা ব্যবসায়ী দায়ী, আড়তদার, হাস্কিং মিল, অটো মিল, কর্পোরেট মিল সবাই দায়ী।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় আনার কথা জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সুগন্ধী চালের বাইরে সাধারণ মানের চাল কতটুকু কিনতে বা বাজারজাত করতে পারবে সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আর মজুত পরিস্থিতি তদারকির জন্য ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রত্যেক মিল মালিককে তার উৎপাদিত চালের বস্তা কিংবা ব্যাগে মিল রেট এবং উৎপাদনের তারিখ লেখা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এজন্য নতুন আইনও প্রণয়ন করা হয়েছে।
সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, এখন বিধিমালা প্রণয়নের কাজ চলছে। ওই আইনে খাদ্য দ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় কোনো অপরাধ পাওয়া গেলে অপরাধীর ন্যূনতম ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি জেলের বিধান রয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে খাদ্য নিয়ে অপরাধমূলক তৎপরতা বন্ধ হয়ে যাবে।
এ ছাড়াও তিনি জেলার খাদ্য বিভাগকেও তিরস্কার করেন। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, খাদ্য বিভাগের পরিদর্শকসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে হয় ঘাস কাটে। তারা প্রতিনিয়ত বাজার পরিদর্শন করেন না। আমরা নির্দেশ দেওয়ার আগ পর্যন্ত তারা বাজারে নামেননি। তারা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না।
মিল মালিকদের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী চাল উৎপাদনের পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য সাত দিন সময় বেঁধে দেন খাদ্যমন্ত্রী।
আসাফ-উদ-দৌলা নিওন/এসএসএইচ