ভোটের রাতে গৃহবধূকে ধর্ষণ, মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন আদালত

নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন রাতে এক গৃহবধূকে (৪০) দলবদ্ধ ধর্ষণের বিষয়টি মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখছেন আদালত।
সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে নোয়াখালী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক (জেলা জজ) ফাতেমা ফেরদৌস আলোচিত এ মামলার রায় দেন।
এ মামলায় ১৬ আসামীর মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয় আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
মামলার পর্যবেক্ষণে বিচারক ফাতেমা ফেরদৌস বলেন, আসামিরা শুধু ভিকটিমের ক্ষতি করেনি বরং রাষ্ট্রেরও ক্ষতি করেছে। এ ধরনের অপরাধ করে আসামিরা যদি খালাস পায় তাতে বিচারক ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়। তাই আসামিরা বিচারকের কোনো ক্ষমা কিংবা করুণা পেতে পারেন না বরং তারা তাদের প্রকৃত অপরাধের সাজা পেলে ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে। ভবিষ্যতে কোনো ব্যক্তি এ ধরনের অপরাধ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে।
এ রায়কে দৃষ্টান্তমূলক হিসেবে তুলে ধরে বিচারক বলেন, এ মামলায় পক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্য, দালিলিক সাক্ষ্য, ভুক্তভোগীর ২২ ধারায় জবানবন্দি, ভুক্তভোগীর ডাক্তারি সনদপত্র প্রদর্শন, আসামিদের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। আইনে বলা আছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী ও শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে নারী বা শিশু আহত হন তাহলে তাদের প্রত্যেককে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজার বিধান আছে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— মৃত খুরশিদ আলমের ছেলে মো. রুহুল আমিন, মৃত আবদুল হাসেমের ছেলে মো. হাসান আলী বুলু, মৃত ইসমাইলের ছেলে মো. সোহেল, মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে স্বপন, আবুল কাশেমের ছেলে ইব্রাহীম খলিল, মৃত ছিডু মিয়ার ছেলে আবুল হোসেন আবু, ফকির আহাম্মদের ছেলে মো. সালাউদ্দিন, মো. মোতাহের হোসেনের ছেলে মো. জসীম উদ্দিন, মো. রফিকের ছেলে মো. মুরাদ ও মৃত চাঁন মিয়ার ছেলে মো. জামাল হেঞ্জু।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন— ইসমাইল হোসেনের ছেলে মো. হানিফ, আবদুল হামিদের ছেলে মো. চৌধুরী, মৃত আহম্মদ উল্যার ছেলে মো. বাদশা আলম, তোফায়েল আহম্মদের ছেলে মোশারফ, মৃত আরব আলীর ছেলে মো. মিন্টু ওরফে হেলাল ও আবুল কালামের ছেলে মো. সোহেল।

বাদীপক্ষের আইনজীবী ও জেলা বারের সাবেক সভাপতি মোল্লা হাবিবুর রছুল মামুন ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, রায়ে বলা হয়েছে এটা কোনো ব্যক্তির ক্ষতি নয়, রাষ্ট্রের ক্ষতি। এটি বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়। এই জাতীয় ঘটনা যদি বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহলে রাষ্ট্রে পরবর্তীতে একই ধরনের অপরাধ সংঘটিত হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের দিন রাতে স্বামী-সন্তানদের বেঁধে রেখে ওই গৃহবধূকে মারধর করে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। বিষয়টি তখন দেশবিদেশে ব্যাপক আলোচনায় জন্ম দেয়। নির্যাতনের শিকার নারী চার সন্তানের জননী। তার অভিযোগ ছিল, ভোটকেন্দ্রে থাকা ব্যক্তিদের পছন্দের প্রতীকে ভোট না দেওয়ার জেরে এ ঘটনা ঘটে।
আদালত সূত্র জানায়, ঘটনার পরদিন ৩১ ডিসেম্বর ভুক্তভোগী গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে ৯ জনের নাম উল্লেখ করে চর জব্বর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। পরে মামলার তদন্ত শেষে সুবর্ণচর উপজেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত প্রচার সম্পাদক রুহুল আমিন মেম্বারসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
এ মামলার রায় গত ১৬ জানুয়ারি দেওয়ার কথা ছিল। সেদিন রায় প্রস্তুত না হওয়ায় তারিখ পরিবর্তন করে ৫ ফেব্রুয়ারি ধার্য করা হয়েছিল।
হাসিব আল আমিন/এএএ