১৩ বছর পর চালু বুড়িমারী এক্সপ্রেস, খুশির চেয়ে অসন্তোষই বেশি

দীর্ঘ ১৩ বছর প্রতীক্ষার পর অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো আন্তনগর ট্রেন বুড়িমারী এক্সপ্রেস। তবে এটি আপাতত লালমনিরহাট-ঢাকা রেলপথে চলাচল করবে। আর জেলার চার উপজেলার যাত্রীদের অন্য ট্রেনে লালমনিরহাট এসে উঠতে হবে বুড়িমারী এক্সপ্রেসে। ফলে ট্রেন চালু নিয়ে খুশির চেয়ে অসন্তোষ হয়েছেন বেশিরভাগ যাত্রী।
মূলত লোকাল একটি ট্রেনের মাধ্যমে ওই যাত্রী বহনে লালমনিরহাট রেলস্টেশনে নিয়ে আসবে। এর মধ্যে আদিতমারী উপজেলায় যাত্রাবিরতি করবে না লোকাল ট্রেনটি। এতে করে বুড়িমারী স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীসহ পুরো জেলাবাসীর প্রশান্তির বদলে অনেকটাই মন খারাপ। এদিকে ট্রেনটি বুড়িমারী থেকে সরাসরি চালুসহ সব কয়েকটি স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেওয়ার দাবি তুলে যাত্রীরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি করেছেন।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে বুড়িমারী রেলওয়ে স্টেশনে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বুড়িমারী এক্সপ্রেস নামের নতুন আন্তনগর ট্রেনটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন। অনুষ্ঠানে ছিলেন জেলার অপর দুই সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান আহমেদ ও মতিয়ার রহমান এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদার। এ ছাড়া সাবেক সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সফুরা বেগম রুমি, লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজার আব্দুস সালাম, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ, পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী দিনে বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনে চালকের দায়িত্বে রয়েছেন শরিফুল ইসলাম ও রাশেদুল ইসলাম এবং পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন শাহিন মিয়া। ১৪টি বগির এই ট্রেনের আসন রয়েছে ৬৫৩টি।
দুপুরে উদ্বোধন হলেও ট্রেনটি রয়েছে বুড়িমারী রেলওয়ে স্টেশনে। এটি নৈশকালীন হওয়ায় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে বুড়িমারী থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে। ৬৩৮টি আসনের মধ্যে প্রথম দিন ৪৩০ জন যাত্রী নিয়ে ছুটবে বহুল প্রত্যাশিত বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেন। পথ দীর্ঘ হওয়ায় আপাতত ট্রেনটি লালমনিরহাট স্টেশন থেকে নিয়মিত যাতায়াত করবে। সেক্ষেত্রে বুড়িমারী স্থলবন্দরের যাত্রীদের জন্য একটি শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে। জেলার প্রতিটি উপজেলায় যাত্রাবিরতি দেওয়ার কথা থাকলেও আদিতমারী স্টেশন কেটে বড়খাতা ইউনিয়ন লেবেলের স্টেশনে যাত্রাবিরতি দেওয়ায় সংক্ষুব্ধ এলাকার মানুষ।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসেছিলেন বহুল আলোচিত আঙ্গোরপোতা-দহগ্রামে। ওইদিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বুড়িমারী-ঢাকা রুটে আন্তনগর ট্রেন চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতিতে তিনি বলেছিলেন, বুড়িমারী স্থলবন্দরসহ সদ্য বিলুপ্ত ছিটমহলবাসীরা সহজেই রাজধানী ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবেন এমন একটি ট্রেন চালু করা হবে। সেই ট্রেনের নাম দেওয়া হবে তিন বিঘা এক্সপ্রেস নামে। ওই ঘোষণার পর থেকেই লালমনিহাটের পাঁচ উপজেলার মানুষের মনে হাজারো আশা জাগে।
সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় সদরদপ্তরে এসেছিলেন ২০১৮ সালের ১১ জুন। লালমনিরহাট রেলস্টেশনের নতুন ভবন উদ্বোধন করেন তিনি। সেই সময় বলেছিলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘তিনবিঘা করিডোর এক্সপ্রেস’ চালুর যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।

এরপর ২০২১ সালের ১২ নভেম্বর লালমনিরহাট রেলওয়ে স্টেশনে এসেছিলেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। স্টেশন পরিদর্শন শেষে তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি শিগগির বাস্তবায়ন করা হবে। খুব তাড়াতাড়ি চালু হবে ‘তিনবিঘা করিডোর এক্সপ্রেস’ ট্রেন। এটি সরাসরি বুড়িমারী থেকে ঢাকায় চলাচল করবে।
কিন্তু, দীর্ঘ ১৩ বছর পর শোনা যায় সেটির নাম বদলে হয়েছে ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেস’। এতেও সাধারণ মানুষের তেমন কোনো কষ্ট নেই।
বুড়িমারী এক্সপ্রেস নামটি হওয়ার পরও নানা নাটকীয়তা হয়েছে চালু ব্যাপারে। উদ্বোধনের কয়েক ধাপ পিছিয়ে অবশেষে (১২ মার্চ) চালু হয়। যেটি বুড়িমারী থেকে যাত্রী নিয়ে আসবে লোকাল ট্রেনে। এরপরেই ট্রেন বদলে বুড়িমারী এক্সপ্রেসে যাত্রীরা যাবে রাজধানী শহর ঢাকায়।
যেভাবে চলবে ট্রেনটি
নির্দেশপত্রে বলা হয়, যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণের জন্য বুড়িমারী-ঢাকা-বুড়িমারী রুটে অবমুক্ত কোচ দিয়ে আরও এক জোড়া বুড়িমারী এক্সপ্রেস পরিচালনার বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত হয়েছে। নতুন বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনের নম্বর হচ্ছে ৮০৯/৮১০। এটি ‘খ’ শ্রেণির আন্তনগর ট্রেন।
বুড়িমারী এক্সপ্রেস (৮০৯) ঢাকা স্টেশন থেকে সকাল সাড়ে ৮টায় ছেড়ে যাবে এবং লালমনিরহাট স্টেশনে পৌঁছাবে সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে। এরপর ট্রেনটি ওই স্টেশনে যুক্ত হবে লালমনিরহাট-বুড়িমারী-লালমনিরহাট রুটের ৪৫৫ নম্বর ট্রেনের সঙ্গে। লালমনিরহাট স্টেশন থেকে ট্রেনটি ৬টা ৫০ মিনিটে ছেড়ে বুড়িমারী রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছাবে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে। অন্যদিকে বুড়িমারী কমিউটার (৪) ট্রেন বুড়িমারী স্টেশন থেকে সন্ধ্যা ৬টায় ছেড়ে এসে লালমনিরহাট স্টেশনে পৌঁছাবে রাত ৮টা ২৫ মিনিটে। ওই স্টেশনে ট্রেনটি যুক্ত হবে বুড়িমারী এক্সপ্রেস (৮১০) ট্রেনের সঙ্গে। ট্রেনটি লালমনিরহাট স্টেশন থেকে ছেড়ে আসবে রাত ৯টা ১০ মিনিটে। ট্রেনটি ঢাকায় পৌঁছাবে সকাল ৭টায়। বুড়িমারী এক্সপ্রেস (৮০৯) বুড়িমারী ট্রেনের সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে সোমবার এবং বুড়িমারী এক্সপ্রেস (৮১০) এর সাপ্তাহিক বন্ধ থাকবে মঙ্গলবার। ১৪ কোচের ট্রেনে মোট আসন থাকবে ৬৩৮/৬৫৩টি। বুড়িমারী এক্সপ্রেস যেসব স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে ৮০৯ নম্বর ট্রেনটি ঢাকা বিমানবন্দর, ঈশ্বরদী বাইপাস, নাটোর, সান্তাহার, বগুড়া, বোনারপাড়া, গাইবান্ধা, কাউনিয়া, লালমনিরহাট, তুষভান্ডার, হাতীবান্ধা, বড়খাতা ও পাটগ্রাম স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।
অন্যদিকে ৮১০ নম্বর ট্রেনটি পাটগ্রাম, বড়খাতা, হাতীবান্ধা, তুষভান্ডার, লালমনিরহাট, কাউনিয়া, গাইবান্ধা, বোনারপাড়া, বগুড়া, সান্তাহার, নাটোর ও ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।
এদিকে লালমনিরহাটের আদিতমারী, রংপুরের পীরগাছা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ও সাদুল্লাপুরের নলডাঙ্গায় ট্রেনটির যাত্রাবিরতি রাখা হয়নি। ফলে এসব এলাকার সাধারণ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যার ফলে আদিতমারীতে মানববন্ধন করেছেন তারা।

আদিতমারীর সুলতান মাহাবুব বলেন, বুড়িমারী থেকে সরাসরি ট্রেনটি চলার কথা থাকলেও সেটি চলবে না। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের দুশ্চিন্তা থেকে গেল। আর বেশ কয়েকটি স্টেশনে যাত্রাবিরতি থাকছে না। যে কারণে বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনটির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এ জেলার মানুষ। আমরা এ অঞ্চলের মানুষ হিসেবে দাবি করছি, দ্রুত বুড়িমারী থেকে সরাসরি ঢাকা যাওয়া সুযোগ যেন থাকে। তাহলে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের যাত্রীরা সহজে এই ট্রেনে ঢাকায় যেতে পারবেন।
বুড়িমারীর ৭০ বছরের শুক্কর আলী জানান, বুড়িমারী এক্সপ্রেস নামে ট্রেন চালু হলেও বুড়িমারীর মানুষ কোনো সুবিধা পাচ্ছে না। লালমনিরহাট কিংবা অনলাইন থেকে টিকিট নিতে হবে। এই অঞ্চলের অনেক মানুষ অনলাইন তেমন বুঝে না। তাই দ্রুত ৫ উপজেলায় টিকিটসহ সব ধরনের সুবিধা দেওয়ার আহ্বান করেছেন।
লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় কমার্শিয়াল ম্যানেজার (ডিসিএম) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ১২ মার্চ ট্রেনটি চালু করা হবে। ইতোমধ্যে ট্রেনটির ট্রায়াল রানও শেষ করা হয়েছে। বুড়িমারী-ঢাকা রুট ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটি হবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম রেলওয়ে রুট। তবে কয়েকটি স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াবে না।
কেন দাঁড়াবে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকা থেকে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদার বলেন, প্রায় ৫৩৬ কিলোমিটারের পথের এই প্রথম কোনো ট্রেন চলাচল করবে। যেটি চালু হলে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য অনেক বদলে যাবে। আপাতত বুড়িমারীসহ কয়েকটি স্থানে যাত্রাবিরতি দেবে। এরপরেই লালমনিরহাট স্টেশনে গিয়ে ট্রেন বদল করতে বুড়িমারী এক্সপ্রেস উঠতে হবে। জানি এতে লালমনিরহাটের ৫ উপজেলার মানুষের কষ্ট হবে। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার বেশি কোনো ট্রেন আমাদের চলাচল করার নিয়ম নেই বলে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এমজেইউ