ফেনীতে চার বছরে তরমুজ চাষ বেড়েছে ৪ গুণ, শত কোটি টাকা বিক্রির আশা
ফেনীর সোনাগাজী উপকূলীয় চরাঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া তরমুজের জন্য বেশ উপযোগী হওয়ায় প্রতি বছরই বাড়ছে আবাদ। আবহাওয়া এবং বাজার অনুকূলে থাকলে চলতি মৌসুমে চাষকৃত ৫৭৬ হেক্টর জমি থেকে ১০৭ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির আশা করছেন কৃষক এবং কৃষি বিভাগ। এই অঞ্চলের তরমুজ আকারে বড় এবং সুস্বাদু হওয়ায় বাজারেও রয়েছে বেশ চাহিদা।
কৃষি বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, একসময় এসব জমি রবি মৌসুমে অনাবাদি ছিল। ২০১৭ সালে নোয়াখালী থেকে আসা এক কৃষক এই উপজেলার চরদরবেশ ইউনিয়নে পরীক্ষামূলক তরমুজ চাষ শুরু করে অভাবনীয় সাফল্য পান। তার সফলতা দেখে ২০১৯ সালে ৮-১০ জন কৃষক তাদের জমিতে রবি মৌসুমে তরমুজ চাষ করেন। এভাবে এই উপজেলায় গত তিন বছরেই ৪৭১ হেক্টর জমিতে তরমুজ চাষের পরিমাণ বেড়েছে।
সূত্র জানায়, উপজেলায় ২০২০ সালে ১০৫ হেক্টর জমিতে ২০২১ সালে ৩১৭ হেক্টর, ২০২২ সালে ৩৪৫ হেক্টর এবং চলতি মৌসুমে ৫৭৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের তরমুজ চাষ করা হয়েছে। গত বছর শিলাবৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টির কারণে কিছু পরিমাণ তরমুজ নষ্ট হওয়ার পরেও ৫০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি করা সম্ভব হয়। চলতি মৌসুমে উপজেলায় ২২৫ হেক্টর জমিতে বাঙ্গালিংক জাত, ১৪৬ হেক্টর জমিতে গৌরী জাত, ৫৫ হেক্টর ব্ল্যাক বেরী জাত, ৮৪ হেক্টর ভিক্টর সুপার জাত, ৫৬ হেক্টর ওপেন সুগার এবং ১০ হেক্টর জমিতে অন্যান্য জাতের তরমুজ চাষ হয়েছে।
কৃষক এবং কৃষি বিভাগ হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, তরমুজ চাষে কানি (৩৯ দশমিক ৬৬৯ শতক) প্রতি সর্বনিম্ন খরচ এক লাখ টাকা এবং বিক্রি আড়াই থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত। সেই হিসাবে এবার ৫৭৬ হেক্টর জমিতে ১০৭ কোটি ৪৫ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৫ টাকার তরমুজ বিক্রি হবে বলে আশা করছেন তারা। এ বছর আবাদকৃত জমিতে ৩০ হাজার ২০৯ মেট্রিক টন তরমুজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষক পর্যায় থেকে পাইকারি বাজারমূল্য কেজিপ্রতি ৩০-৩৫ টাকা হলেও শত কোটি টাকার বেশি বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। উপজেলায় এবার তরমুজ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে ৩ হাজার ৮৫০ জন কৃষক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর থেকে আসা আমান উল্ল্যাহ নামের এক তরমুজ চাষি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ১০ জন সোনাগাজীর চরদরবেশ এলাকায় এসে ৫৬ কানি জমিতে তরমুজ চাষ করেছি। পৌষ মাসের শুরুতে রোপণ করে ফেব্রুয়ারি মাসে ফলন এসেছে। কানি প্রতি খরচ হয়েছে এক লাখ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার কানিপ্রতি তরমুজ বিক্রি হবে ৩ লাখ টাকার মতো।
আমিরাবাদ ইউনিয়নের তরমুজ চাষি মিলন বলেন, উপযুক্ত মাটি ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে তরমুজের মৌসুমে খালি জমি পাওয়ায় সোনাগাজীতে তরমুজ চাষে বিপ্লব ঘটেছে। গত বছর ৩৫ একর জমিতে তরমুজ চাষ করে লাভবান হওয়ায় এবার ১০০ একর জায়গায় তরমুজ আবাদ করেছি।
কালাম, হেনজু এবং মিলনসহ আরও কয়েকজন কৃষক ঢাকা পোস্টকে বলেন, তরমুজ চাষে আগে থেকে কোনো কিছু ধারণা করে বলা যায় না। সব ঠিক থাকলে মৌসুমে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি লাভের সুযোগ থাকে। আবার কখনো জমি বর্গার টাকাও ওঠে না।
তরমুজ চাষি রেজাউল বলেন, গত বছর হঠাৎ অতিবৃষ্টির কারণে মাঠের সব তরমুজ ভেসে ওঠে। তখন পাইকাররা জমির তরমুজ না নিয়েই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এতে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তরমুজ নষ্ট হয়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবার চাষ বেড়েছে। যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে তাহলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা সহজেই অর্জিত হবে। কৃষক পর্যায় থেকে হিসাব করলে আবাদকৃত তরমুজের পাইকারি বাজারমূল্য শত কোটি টাকার বেশি। যদিও আমরা মূল্য নির্ধারণ এবং বাজারজাতকরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না, তারপরও কৃষি বিভাগের পর্যবেক্ষণে সর্বনিম্ন ৩০ টাকা কেজি দরে অথবা কানি প্রতি (৩৯ দশমিক ৬৬৯ শতাংশ) দাম আড়াই লাখ টাকা করে হলেও বাজারমূল্য ৯০ কোটি টাকা।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্রনাথ বলেন, ফেনী জেলার মধ্যে শুধু সোনাগাজী উপজেলায় চরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ ভূমি রয়েছে। এখানকার মাটি এবং আবহাওয়া তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বীজ রোপণ করার পর তিন মাসের মধ্যে ফলন পাওয়া যায়। পরিচর্যা খরচের তুলনায় আয় বেশি হওয়ায় এখন মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন।
তরমুজ চাষে ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, তরমুজ চাষে যেমন লাভের সম্ভাবনা বেশি, তেমনি রয়েছে ঝুঁকিও। সঠিক পদ্ধতি অনুযায়ী চাষাবাদ না করলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলে চাষি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আল-আমিন শেখ বলেন, তরমুজ চাষে হঠাৎ ক্ষতির সম্ভাবনা শতকরা ৫০ শতাংশ। চাষি ঝুঁকি নিয়ে এবং আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে তরমুজ চাষ করেন। গত বছর শিলাবৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টির কারণে তরমুজ নষ্ট হয়ে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপরও ৫০ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রি করা সম্ভব হয়েছিল। অনুকূল আবহাওয়া থাকলে বিক্রির পরিমাণ আরও অনেক বেশি হত।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, শুরুতে শুধু উপজেলার চরদরবেশ এলাকায় তরমুজ চাষ হত। তবে কম সময়ে উৎপাদন ও লাভবান হওয়ায় অনেকে এখন তরমুজ চাষে ঝুঁকছেন। বর্তমানে উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন এবং পৌরসভায় একযোগে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন জাতের তরমুজ। কৃষি বিভাগ সবসময় চাষিদের পরামর্শ দিয়ে পাশে রয়েছে।
তারেক চৌধুরী/এমজেইউ