ঈদের ফিরতি যাত্রায় টিকিট সংকট, কালোবাজারে দ্বিগুণ দাম
আপনজনদের সঙ্গে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন শেষে কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানের কর্মজীবী মানুষ। রংপুর থেকেও রাজধানীসহ অন্যান্য গন্তব্যে ফিরছেন কর্মজীবীরা। প্রতিবারের মতো এবারও এসব মানুষ টিকিট বিড়ম্বনায় পড়েছেন।
রংপুরে ঈদ-পরবর্তী বাস, ট্রেন ও বিমানের টিকেট সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রীদের অভিযোগ কালোবাজারিদের হাতে চলে গেছে এসব টিকিট। বাস টার্মিনাল ও কাউন্টারগুলোতে চলছে অগ্রিম টিকিটের হাহাকার। কাঙিক্ষত টিকিট পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে যাত্রীদের। অথচ কালোবাজারিদের হাতে বাড়তি দাম ধরিয়ে দিলেই পাওয়া যাচ্ছে টিকিট।
রংপুরের কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ড ও রংপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে টিকিটের জন্য যাত্রীদের উদ্বেগ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। কাউন্টারে টিকিট না পাওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে অনেকের মধ্যে। নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে ফেরা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের দাবি, ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে টানা এক সপ্তাহের টিকিট আগাম বিক্রি হওয়ায় এ দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে।
‘টিকিট নেই, টিকিট আছে’ এমন নাটকের কবলে পড়া সাধারণ যাত্রীরা জানান, কাউন্টারগুলোতে টিকিট না পাওয়া গেলেও এর ঠিক বাইরেই বেশি দামে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। এসব নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় একটি কালোবাজারি চক্রসহ বাস মালিক ও শ্রমিকরা।
কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ডে এনা পরিবহন কাউন্টারের পাশে কথা হয় মিঠাপুকুর শঠিবাড়ির এলাকা থেকে আসা সেলিম মিয়ার সঙ্গে। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে এক কালোবাজারি টিকিট বিক্রেতার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন রবিউল ইসলাম ও মেহেরুন রুনি নামে দুজন যাত্রী। তারা দুজনই ঈদের ৬ষ্ঠ দিনে ঢাকায় ফেরার জন্য টিকিট নিতে এসেছিলেন। কিন্তু টিকিট না পেয়ে হতাশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রবিউল ইসলাম জানান, ঈদের ছুটি শেষ হওয়ার আগে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে না পারলে চাকরি হারাতেও হতে পারে। সেলিম মিয়া নামে একজন অভিযোগ করেন, কালোবাজারি ছাড়া কখনোই টিকিট কাটতে পারেননি তিনি। এবারও হয়ত একই অবস্থা হবে। এ সময় তিনি কালোবাজারিদের টিকিট ব্যবসা বন্ধসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান।
অন্যদিকে নাজমুল হাসান ও নূর হোসেন নামে দুজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী জানান, তারা দুজন তিন হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে এসি বাসের ২টি টিকিট নিয়েছেন।
এনা পরিবহনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের আগেই ঈদ-পরবর্তী যাত্রার আট-দশ দিনের টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। অনেকে সিট বুকিং দিয়ে রেখেছেন। এ কারণে তারা যাত্রীদের কাঙ্ক্ষিত টিকিট দিতে পারছেন না। বিশেষ করে এক সপ্তাহের কোনো টিকিট তাদের হাতে নেই। তবে বাইরের চিত্র আলাদা। কাউন্টারে টিকিট না মিললেও বাইরে কালোবাজারিসহ ওই কাউন্টারের কলার বয়দের বাড়তি টাকা দিলেই মিলছে টিকিট।
এ চিত্র শুধু এনা পরিবহনে নয়, কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ডের প্রতিটি কাউন্টারে টিকিট নিয়ে এমন লুকোচুরি চলছে। যা নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের শেষ নেই।
কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা অনেক চেষ্টা করে দ্বিগুণ দামেও টিকিট পাচ্ছেন না। কাউন্টার থেকে দেখানো হচ্ছে অনলাইনের অজুহাত। টিকিট সব নাকি বিক্রি হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় কে কীভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না তারা।
অন্যদিকে রংপুর বিভাগের প্রবেশদ্বার ও বাহির মুখ মডার্ন মোড়ে দেখা গেছে, কর্মজীবী মানুষের উপচে পড়া ভিড়। উত্তরের জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও রংপুরের মানুষ মডার্ন মোড় থেকে গাড়িতে উঠছেন। রংপুরসহ বাইরের জেলা থেকে এসে অনেকেই কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য মর্ডান মোড়ে জমায়েত হচ্ছেন বাসের জন্য। প্রচুর পরিমাণে বাস থাকার পরও বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা অভিযোগ করে বলেন, রংপুর থেকে ঢাকার ভাড়া বাস ভেদে ৭-৮শ টাকা হলেও ঈদ উপলক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। এতে বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের। কেননা তারা ঈদে সব টাকা খরচ করে ফেলেছেন। অল্পকিছু রেখেছেন মাস চালানোর জন্য। এখন বাস ভাড়া এত বেশি দিলে মাস চলবেন কীভাবে?
এদিকে রংপুর মহানগরীর কেন্দ্রীয় সিটি বাস টার্মিনাল ও ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবহন কর্মীরাসহ একটি মহল বাড়তি দামে টিকিট বিক্রির আশায় ঈদের পরের কয়েকদিনের টিকিট আটকে রেখেছেন। নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দাম পেলেই হাত বদল হচ্ছে এসব টিকিটের।
কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডে শ্যামলী পরিবহন, এসআর, নাবিল পরিবহন, হানিফ পরিবহন, এনা পরিবহন, রংধনু, শাহ ফতেহ আলী পরিবহনসহ বেশ কয়েকটি কাউন্টারে টিকিটের জন্য যাত্রীদের ধরনা দিতে দেখা গেছে। কলার বয় এবং গাড়ির স্টাফরা কাউন্টারে টিকিট নেই বলে সাফ জানিয়ে দিলেও তাদেরই কয়েকজনকে বাইরে টিকিট ম্যানেজ মিশনে ব্যস্ত সময় কাটাতে দেখা যায়।
বোম্বাট নামে এক পরিবহন শ্রমিক জানান, টিকিট পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। সিট কন্ডিশন খুব ভালো হবে না। তারপরও যদি কেউ পায় সেটা তার ভাগ্য।
মোটর শ্রমিক ফেডারেশন রংপুর মডার্ন শাখার সভাপতি হাবিব বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মোটর মালিক সমিতির সহযোগিতায় যাত্রীদের সেবা সুন্দরভাবে দেওয়া হচ্ছে। আগামী শনি-রোববার পর্যন্ত যাত্রীদের চাপ থাকবে।
ভাড়া বেশি নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভাড়া আমরা বেশি নিচ্ছি না, বহিরাগত কিছু লোক ভাড়া বেশি নিয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ডে হানিফ পরিবহনের এক স্টাফ জানান, ১৮ তারিখ পর্যন্ত টিকিট দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, স্থানীয় কিছু যুবকদের একটি সিন্ডিকেট আগে থেকেই বিভিন্ন নামে বেনামে জনপ্রতি ৫০ থেকে ৭০টি করে টিকিট কিনে রেখেছে। ওই টিকিটগুলো তারা এখন কলার বয়দের দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছে।
কালোবাজারিরা কীভাবে টিকিট পাচ্ছে এ বিষয়ে কিছু না বললেও তিনি আরও জানান, এখন যারা কাউন্টার থেকে টিকিট পাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই পরিচিত লোকজন। টিকিটের এই পরিকল্পিত সংকট ঈদের ১০দিন পর্যন্ত থাকবে বলে জানান তিনি।
এদিকে বাসের টিকিটের মতো আগুন লেগেছে ট্রেনের টিকিটেও। রংপুর এক্সপ্রেস, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস আন্তঃনগর ট্রেনেরও টিকিট মিলছে না। শুধু তাই নয়, শিডিউল বিপর্যয় নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে যাত্রীদের। ঈদের আগের মতো পরেও যাত্রীসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে রেলওয়ে বিভাগ।
রংপুর রেলস্টেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখানেও খোঁজ নেই ঈদ-পরবর্তী ৭ দিনের টিকিটের। সাধারণ যাত্রীরা ধরনা দিয়ে টিকিট না পেলেও সামান্য হাই হ্যালোতে টিকিট পাচ্ছেন প্রভাবশালী মানুষেরা।
একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, বাসের টিকিটের মতো ট্রেনের টিকিটও কালোবাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ট্রেনের যাত্রীরা বলছেন, টিকিট নিয়ে সব জায়গাতেই এখন বাণিজ্যের মহোৎসব শুরু হয়েছে। অথচ এ বিষয়ে সরকার ও স্থানীয় প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার আল ইমরান বলেন, কালোবাজারিদের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ছাড় নেই। আমরা কোনো অভিযোগ পেলে যাচাই-বাছাই করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।
এএএ
