১২ বছর ধরে পুকুরের পানি খান ১০ গ্রামের মানুষ

শুকনো মৌসুমে এখানে খাবার পানির সংকট নিত্যদিনের। বৃষ্টি হলে আমরা কিছুটা বাঁচি। এ বছর বৃষ্টি নেই, পানিও নেই। এখন এলাকার কোথাও বিশুদ্ধ পানি নেই। বাধ্য হয়ে পুকুরের পানি খাচ্ছি। ১২ বছর ধরে পুকুরের পানি খেয়েই বেঁচে আছি। দেখার কেউ নেই।
গ্রামে বিশুদ্ধ পানির সংকটের কথা বলছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার সোরা গ্রামের কুলসুম বেগম। কুলসুম বেগম ওই গ্রামের আশরাফুল শেখের স্ত্রী।
শুধু কুলসুম বেগম নন, সোরা গ্রামের সব মানুষ এখন পুকুরের পানি পান করেন। তাদের পাশাপাশি গাবুরা ইউনিয়নের অন্য ৯ গ্রামের মানুষও পুকুরের পানি পান করেন। দূরদূরান্ত থেকে এসে দলবেঁধে পুকুরের পানি সংগ্রহ করেন তারা। পুকুরের পানি জীবনধারণের জন্য নিরাপদ কি না তা জানেন না তারা।
উপকূলীয় মানুষের দুঃখ-কষ্ট, জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছেন ঢাকা পোস্টের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব আজ।
শ্যামনগর উপজেলা থেকে নীলডুমুর খেয়াঘাট পার হয়ে গাবুরা ইউনিয়নে যেতে হয়। কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত এ ইউনিয়ন। চারপাশে নদ-নদী আর সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায় দ্বীপ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত এটি। পুরো ইউনিয়নে বিশুদ্ধ পানির সংকট বহুদিনের।
সোরা গ্রামের বিলকিস বেগম বলেন, ‘৪-৫ কিলোমিটার দূর থেকে এই পুকুরের পানি নিতে আসে মানুষ। গ্রামের কোথাও পানি নেই। এই পুকুরেও অল্প পানি, দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। তখন পানির জন্য কোথায় যাব, জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে গ্রামের টিউবওয়েলে লবণাক্ত পানি ওঠে। তখন থেকে আমরা পুকুরের পানি খাই। বর্ষাকালে বৃষ্টির পানি ধরি। আমাদের মতো অসহায় মানুষ দেশের কোথাও আছে কি না জানি না।’
সোরা গ্রামের পুকুরের পানি প্লাস্টিকের ড্রামে ভরে বিক্রি করে সংসার চালান ভ্যানচালক বিল্লাল হোসেন। তিনি ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ডুমুরিয়া গ্রামের আবেয়ার রহমানের ছেলে।
বিল্লাল হোসেন বলেন, গ্রামের কোথাও বিশুদ্ধ খাবার পানি নেই। আমি তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি দিয়ে আসি। সেজন্য ২০ লিটারের প্রতি ড্রাম পানির মূল্য নিই ২০ টাকা। দূরত্ব আরও বাড়লে কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকা করে নিই। তবে এটি পানির মূল্য নয়; আমার পারিশ্রমিক। পুকুর থেকে পানি নিতে কোনো টাকা লাগে না, যে কেউ নিতে পারবেন। তবে মাস খানেকের মধ্যে যদি বৃষ্টি না হয়; তাহলে এই পুকুরের পানিও ফুরিয়ে যাবে। তখন গ্রামের কোথাও আর পানি পাওয়া যাবে না।
ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ১৫টি গ্রাম নিয়ে গঠিত গাবুরা ইউনিয়ন। ইউনিয়নের বাসিন্দা ৪৩ হাজার ২৬২ জন। এর মধ্যে পাঁচটি গ্রামের গভীর নলকূপে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায়। তাও নলকূপের সংখ্যা খুবই কম। বাকি গ্রামগুলোতে সুপেয় পানি নেই। পুকুর ও নর্দমার পানি পান করে এসব গ্রামের মানুষ। অনেকে ট্রলারের মাধ্যমে দূর থেকে ড্রামে করে পানি এনে ব্যবহার করেন।
গাবুরা ইউনিয়নের চাঁদনিমুখা এমএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহাসিন হুসাইন বলেন, ‘আইলার আগে সুপেয় পানির সংকট বেশি ছিল না। আইলার পর এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দেয়। গত বছর আম্পানের পর বিশুদ্ধ পানির সংকট আরও বেড়ে যায়। এই সংকট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।’
একই ইউনিয়নের পার্শ্বেমারী গ্রামের মফিজুল ইসলাম স্ত্রীকে নিয়ে নৌকায় চড়ে প্রতিদিন পানি আনতে যান বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনাখালি গ্রামে। সেখান থেকে আনা পানিতে পরিবারের ছয় সদস্যের জীবন চলে।
মফিজুল ইসলাম বলেন, দুদিন পরপর পানি আনি। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করি। এখন বৃষ্টি নেই। তাই পাঁচ কিলোমিটার দূর থেকে পানি এনে খেতে হয়। খাবার পানির খুব অভাব।
গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম বলেন, ‘গ্রামে গ্রামে পানির জন্য হাহাকার চলছে। কোথাও বিশুদ্ধ পানি নেই। পুকুর-নর্দমার পানি খেয়ে জীবনধারণ করছে মানুষ। বেঁচে থাকার জন্য এমন ময়লা-আবর্জনাযুক্ত পানি খেতে হয়। এসব পানি ব্যবহার করায় মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ইউনিয়নের ১৫ গ্রামের মধ্যে পাঁচটি গ্রামের কিছু নলকূপে সুপেয় পানি পাওয়া যায়। সেসব গ্রাম থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে যদি সুপেয় পানি অন্য গ্রামে নেওয়া যায় তাহলে কিছুটা কষ্ট দূর হবে মানুষের।’
গাবুরার পাশেরন ইউনিয়ন বুড়িগোয়ালিনী। এ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল বলেন, ‘উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় প্রতি বছর দুর্যোগের মুখে পড়ে এই অঞ্চল। আমার ইউনিয়নের প্রধান সমস্যা- সুপেয় পানির সংকট। পানির সংকট দূর করতে গত পাঁচ বছর ধরে বিভিন্ন এনজিও ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি, বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। পরিবারভিত্তিক ট্যাংক, রেনেটা হার্ভেস্টের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমাদের এখানে ভূগর্ভস্থ পানির লেয়ার অনেক নিচে। এখানে গভীর নলকূপ বসালেও সুপেয় পানি পাওয়া যায় না। লবণাক্ত পানি ওঠে।’
সাতক্ষীরা জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী আরশাদ আলী বলেন, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপকূলীয় অঞ্চলে খাবার পানির তীব্র সংকট রয়েছে। ইউনিসেফের সহযোগিতায় আগামী দুই মাসের মধ্যে জিফিএ নামে একটি প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে জরিপ সম্পন্ন হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্প শেষ হবে। দুই উপজেলার ‘পানি সংকটপূর্ণ এলাকা’য় পুকুর পাড়ে পিএসএফ (পন্ডসেন্ট ফিল্টার) বসানো হবে। সেখান থেকে মানুষ বিশুদ্ধ পানি পাবে।
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শেষ হলে খাবার পানির সংকট থাকবে না। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় এলাকায় পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে খাবার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। দুই উপজেলা মিলে সাতটি ফিল্টার রয়েছে। বর্তমানে সেখান থেকে মানুষ পানি পান করছে। কষ্ট করে দূর থেকে এনে তাদের পানি পান করতে হয়। আগামী দুই বছর পর এ সমস্যা থাকবে না।’ে
এএম/জেএস