‘৭৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পায় না’
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান বলেছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয় কমে যাচ্ছে। এতে অনেকেরই ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আমরা যদি নিজেদের পুষ্টির উৎপাদন ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে বেশি মূল্যে বাজার থেকে পুষ্টিকর খাবার কিনতে হবে না। বিকল্প হিসেবে পারিবারিক পুষ্টি কৃষির মডেল তৈরি করতে হবে। পুষ্টিকর খাবার উৎপাদনে নিজেদের পতিত জমিতে পুষ্টিকর সবজি চাষ করা গুরুত্বপূর্ণ। নয়তো ভবিষ্যতে আমাদের জন্য দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে।
সোমবার (২৯ এপ্রিল) বরিশালের একটি হোটেলে পুষ্টিখাতে অর্থায়ন শীর্ষক সংলাপে এসব কথা বলেন তিনি।
নাসিরুজ্জামান আরো বলেন, জরিপ বলছে দেশের ৩৬ শতাংশ মানুষ খর্বাকার। ৭৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পায় না। পুষ্টি বলতে সাধারণত মানুষ বুঝে থাকে মাছ, মাংস, দুধ ও ডিমকে। কিন্তু শাকসবজিতেও যে পুষ্টি রয়েছে তা ধারণা নেই। এজন্য সরকার ‘আমার আঙিনা-আমার পুষ্টি’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, দেশের মোট কৃষকের ৪৮ শতাংশ বর্গা চাষি। তারা সাধারণত জমিতে কৃষি বলতে ধান চাষ আর কলাগাছ রোপনকে বোঝেন। এর পাশাপাশি পুষ্টিকর সবজি উৎপাদনে জোর দিতে হবে।
পুষ্টি কৃষিতে সরকারের চেয়ে বেসরকারি বিনিয়োগ কার্যকর উল্লেখ করে বলেন, খাদ্যাভাব পূরণে মানুষ সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণ করেন উন্নয়ন সংস্থা থেকে। এটা সরকারি ব্যাংকের ব্যর্থতা। সরকারি ব্যাংকে কৃষক ঋণ নিতে গেলে তার জামানত আছে কিনা, কি কি কাগজপত্র আছে তা চায়। এতে কৃষক নিরুৎসাহিত হন। এসব বিবেচনা করে জামানতবিহীন সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ঋণ প্রদান করছে কৃষি ব্যাংক। ১০ টাকার কৃষক অ্যাকাউন্ট চালু করে একজন কৃষক তার বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের জন্য এই ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন। ১২ মাসে তিনি ঋণ পরিশোধ করবেন। ঋণ নিতে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্রই যথেষ্ট।
পুষ্টিখাতের অগ্রগতির জন্য হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ড. জিয়াকুন শি। তিনি বলেন, পুষ্টি নিরাপত্তায় ১৯৭৬ সাল থেকে আমরা কাজ করছি। পুষ্টি উন্নয়নে ইতোমধ্যে ২৫০টিরও বেশি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ পুষ্টির বিষয়ে সবসময়ে সচেতন ও সহায়ক মানসিকতার।
তিনি বলেন, ভালো উৎপাদন, পুষ্টি, ভালো পরিবেশ সুন্দ ও জীবন ধারণ এই চারটি গ্ররুত্বপূর্ণ বিষয় বাস্তবায়নে জাতিসংঘ অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা পুষ্টির গুরুত্ব হয়তো কম-বেশি সবাই জেনেছি। নাগরিকদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে সুন্দর জাতি গঠিত হবে। জাতিসংঘের খাদ্যসংস্থা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুর মতো কাজ করছে। শুধু সরকার নয় আমরা সবাই যদি পুষ্টি নিশ্চিতে এগিয়ে আসি তাহলে বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে।
সংলাপে মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কারিগরি সহায়তা সমন্বয়কারী ইমানুন নবী খান। তার বক্তব্যে তিনি পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০২৪ সালের মার্চ মাসের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেন, দেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে শুরু করে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মখিন। আর যাদের মূল পেশা কৃষি তাদের মধ্যে ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় আছে। এছাড়া শতকরা ২৫ দশমিক ৫ ভাগ পরিবার দৈনন্দিন খাবার কিনতে ঋণ করতে হচ্ছে। যা বছরে ৪৯ হাজার টাকার সমান।
খাদ্যের অনিশ্চয়তার ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে নাগরিকদের রক্ত স্বল্পতার প্রতিবেদনে। ২০১২ সালে রক্তস্বল্পতায় ভুগতো ৩৫ দশমিক ৭০ ভাগ মানুষ। ২০১৯ সালে ১ শতাংশ বেড়ে দাড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৭০ শতাংশে।
ইমামুন নবী খান বলেন, দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে অন্যান্য খাতসমূহের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিখাত। আইএফপিআরআই ২০১৫ সালের প্রতিদবেদন বলছে, পুষ্টিখাতে ১ টাকা বিনিয়োগ করলে ১৬ টাকা লাভ হয়। অর্থাৎ ১৬ ভাগ ফেরত আসে।
কারণ ভালো উৎপাদন হলে ভালো পুষ্টির ব্যবস্থা হবে। ভালো পুষ্টি হলে সুন্দর পরিবেশ হবে। সুন্দর পরিবেশ হলে নাগরিকদের সুন্দর জীবন ব্যবস্থা হবে। এজন্য পুষ্টি সংবেদনশীল কৃষিতে সরকারি, বেসরকারি অর্ন্তভুক্তিমূলক বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা জরুরি, সংযোগ কৃষিতে পুষ্টি সংবেদনশীল বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে এবং পুষ্টি সংবেদনশীল বিনিয়োগে নির্দিষ্ট সুপারিশমালা প্রণয়ন করতে হবে।
বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুল হক পাটওয়ারীর সঞ্চালনায় আলোচক ছিলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. দেবাশীষ সরকার, ডাচ বাংলা ব্যাংকের সিএসআর রিসার্চ প্রোগ্রাম কমিটির চেয়ারম্যান ড. মো. মঞ্জুরুল আলম, বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক মো. শহীদ রেজা, সারাবাংলা কৃষক সোসাইটির সভাপতি রিতা ব্রাহ্ম। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রোগ্রাম প্রতিনিধি নূর আহমেদ খন্দকার।
সংলাপ শেষে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের ৩০টি উৎপাদরকারী সংগঠনের নারী কৃষকদের হাতে ১০ হাজার টাকার জামানতমুক্ত ১০ হাজার টাকার ঋণ চেক এবং পুষ্টিকর সবজি উৎপাদনের জন্য বীজ তুলে দেন অতিথিরা।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরকে