৭ বছরের শিশুকে ধর্ষণ, অভিযুক্ত যুবককে নপুংসক দাবি পরিবারের
নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার সুতারপুর গ্রামে রাব্বি ভূইয়া (২৫) নামে এক যুবকের বিরুদ্ধে সাত বছরের এক মাদরাসাছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্ত রাব্বি ভূইয়া সুতারপুর গ্রামের মো. রফিকুল ভূইয়ার ছেলে। গত ২১ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হলেও এখন পর্যন্ত আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় ভুক্তভোগীর পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে বলে দাবি করেছে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ২১ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মাদরাসা থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্রতিবেশি রাব্বি ভূইয়া ওই শিশুটিকে তার দাদি ডাকছে বলে একটি নির্মাণাধীন বাড়িতে নিয়ে যান। পরে সেখানে শিশুটিকে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনা কাউকে বললে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেন শিশুটিকে। পরে শিশুটি বাড়ি ফিরে তার খালাকে ঘটনা বললে ওই দিনই তাকে নেত্রকোণা আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসা শেষে গত শনিবার (২৭ এপ্রিল) শিশুটিকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যান স্বজনরা। এ ঘটনায় শিশুটির মা কবিতা আক্তার বাদী হয়ে রাব্বি ভূইয়াকে আসামি করে গত ২৪ এপ্রিল আটপাড়া থানায় মামলা করেন।
যা বলছেন আসামিপক্ষের লোকজন
সরেজমিনে সুতারপুর গ্রামে গিয়ে অভিযুক্ত রাব্বিকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। এমনকি বাড়িতে ছিলেন না তার বাবা রফিকুল ভূইয়া। আসামি রাব্বির সম্পর্কে চাচা মো. সেলিম ভূঁইয়ার দাবি, মামলাটি সম্পূর্ণ বানোয়াট। ধর্ষণের মতো ঘটনা এখানে ঘটেনি। তারা পুরোনো শত্রুতার জের ধরে এই মামলা করেছে। এর পেছনে এলাকার কিছু দুষ্টু প্রকৃতির লোকের ইন্ধন আছে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এই ঘটনা ঘটলে ওই বাচ্চাটা পুকুরে গোসল করে কীভাবে। আম কুড়াইয়া নেয় কীভাবে।
সেলিম ভূঁইয়া দাবি করে বলেন, আমার ভাতিজা লিঙ্গ প্রতিবন্ধী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার দুইবার অপারেশন করা হয়েছে। রাব্বির অণ্ডকোষের মাঝখান দিয়ে প্রস্রাবের রাস্তা ছিল। যেটা ঠিক করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১১ এবং ২০১৩ সালে দুটি অপারেশন করা হয়। আরো একটি অপারেশন করতে হবে বলে ডাক্তার বলেছিলেন, যেটি এখনো করা হয়নি।
রাব্বির প্রতিবেশী শাহনূর আলম বলেন, ‘শুনলাম বাচ্চাটার দাদি নাকি বিচার নিয়ে আইছে। রাব্বি নাকি বাচ্চাটারে থাপ্পড় মারছে এইডার বিচার চায়। একটু পরে তারা চইলা যায়। পরে আবার অন্য অভিযোগ নিয়া আইছে, এর আগে এইরম কিছু কয় নাই। যে পুলাডার নামে অভিযোগ করেছে সে নামাজ পড়ে, ছোট-বড় সবার সাথেই ভালো আচরণ করে। আর যে মেয়েটা অভিযোগ করছে সে বিচার দেওয়ার একটু পরেই পুকুরে গোসল করে ক্যামনে?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অভিযুক্ত রাব্বির এক প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিনি যখন ঘটনাস্থলের পাশেই কাজ করছিলেন তখন ছোট বাচ্চাটা তার দাদির সঙ্গে অভিযোগ নিয়ে আসে যে, রাব্বি নাকি তাকে থাপ্পড় মেরেছে। এ অভিযোগ শুনার পর আমি ঘটনাস্থল থেকে চলে যাই। নামাজ ও অন্য কাজে আশরাফুল উলুম মাদরাসা এলাকায় ছিলাম। কিন্তু আমি যখন সন্ধ্যার আগে যখন এলাকায় আসলাম, তখন জানলাম তারা মেয়েকে নিয়ে নেত্রকোণা হাসপাতালে চলে গেছে, আমি এতোটুকুই জানি। মাঝখানে অনেকটা সময় আমি এদিকে ছিলাম না।
রাব্বি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। পাশাপাশি অভিযুক্তের শারীরিক অক্ষমতার বিষয়টিও জানি। তার দুইবার অপারেশন করা হয়েছে বলে জানি।
যা বলছে ভুক্তভোগী শিশুর পরিবার
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে ভুক্তভোগী শিশুর খালা বলেন, আমি বাড়িতে কাপড় রোদে দিতেছিলাম এমন সময় দেখি মেয়েটা কান্না করতে করতে বাড়িতে ঢুকতেছে। কী হইছে জানতে চাইলে বলে, একটা লোক তারে ডাইকা একটা ঘরে নিয়া মারছে। জানতে চাইলাম কেন মারছে? সে কিছু বলে না। তখন দেখলাম গাল ফুলে গেছে। পরে বার বার জানতে চাইলে বলে, তারে ডাইকা নিয়া কাপড় খুলতে বলছে। কাপড় না খোলায় তাকে চড়-থাপ্পড় মারছে। পরে সে ঘটনার বিস্তারিত জানায় কীভাবে তাকে ওই লোক জোর করে এই কাজ করেছে। মেয়েটা যখন দৌঁড়ে পালিয়ে আসে তখন রাব্বি পেছন থেকে বলে, “কেউরে কিছু কইলে গলা কাইট্টা ধান ক্ষেতে ফালায়া দিমু।’ এই ভয়ে সে প্রথমে কাউরে কিছু বলে নাই।
শিশুটির দাদি বলেন, ‘প্রথমে আমরা ভাবছিলাম খালি চড়-থাপ্পড় মারছে। পরে যখন দেখলাম মেয়ের শরীর দুর্বল হইয়া কাঁপতেছিল তখন বার বার জিগাইলে পরে কইছে যে রাব্বি তারে কী কী করছে। মাইয়াডা যহন আইতাছে তহন অনেকেই দেখছে কিন্তু ভয়ে কেউ সাক্ষী দেবে না, হেরার তো মেলা ক্ষমতা। মীমাংসার কথা কইলে তারা মেম্বার-চেয়ারম্যান নিয়া দরবারে রাজি না। এহন মামলা করছি দেইহা কয় আমরার ধান কাইট্টা লইয়া যাইব, গরু নিয়া বেইচা দিব কইয়া ডর দেহায়। আমরা তো গরিব মানুষ, আমরার কেই নাই।
অভিযুক্তের শারীরিক সমস্যার বিষয়টা জানেন কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ছোডবেলায় সমস্যা ছিল এইটা ঠিক। কিন্তু দুইবার ঢাকা গিয়া অপারেশন কইরা আইছে। এখন সে সুস্থ এইডা সবাই জানে।’
শিশুটির বাবা বলেন, আমি ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করি। মেয়েটাকে মাদরাসায় ভর্তি করলাম ভালো ভবিষ্যতের আসায়। আর আমার এই মেয়েটার এমন অবস্থা করল? আমি ঘটনা শুনে বাড়িতে এসে তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বলে, আমরা এটা নিয়া দরবার করতে রাজি না। আমি চাইছিলাম সামাজিকভাবে বিষয়টা শেষ করার। কিন্তু তারা রাজি না থাকায় আমি মামলা করতে বাধ্য হইছি। মামলার পর থেকে আমাদের বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখায়।
শিশুটির মা ক্ষোভ নিয়ে বলেন, এমন একটা বাচ্চার সাথে কেউ এমন জঘন্য কাজ করে? আমি ঢাকায় কাজ করি, মেয়েটা শাশুড়ির কাছে থাকে। মাদরাসা থেকে বাসায় যাওয়ার পথে তার সাথে খারপ কাজ করল। আবার বাচ্চাটারে ভয় দেখিয়ে বলে, ‘কাউরে কিছু কইলে গলা কাইট্টা ধান ক্ষেতে ফালায়া দিব।’ বিচার চাইয়াও পাইলাম না। পরে যখন মেয়েটারে হাসপাতালে নিতে গেলাম তারা বাধা দিল। পরে লুকিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে বাচ্চাটারে হাসপাতালে নিয়া আসা লাগছে। আমি এটার সুষ্ঠু বিচার চাই।
যা বলছেন চিকিৎসক
নেত্রকোণা জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. একরামুল হাসান জানান, গত ২১ এপ্রিল সাত বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তখন তাকে সাধারণ চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে ধর্ষণের আলামত আছে কিনা তা আমাদের গাইনিকোলজিস্ট ডাক্তারের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। রিপোর্ট সম্পূর্ণ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না
অভিযুক্ত রাব্বি কি সত্যিই নপুংসক?
সত্যিই রাব্বি লিঙ্গ প্রতিবন্ধী কিনা তা জানতে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে চিকিৎসাপত্র ও রিপোর্ট দেখে তিনি জানান, তার পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোষে জন্মগতভাবে একটা সমস্যা ছিল এটা সত্যি। অপারেশনের পর তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এ ধরনের সমস্যার ক্ষেত্রে সাধারনত ৫০ শতাংশ সুস্থ হবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এখন তার কী অবস্থা এটা পরীক্ষা না করে বলা যাবে না। যেহেতু ১২ বছর আগের ঘটনা। তবে তার রিপোর্ট অনুযায়ী, শারীরিক সক্ষমতার ঘাটতি থাকলেও মানসিকভাবে সহবাসের আগ্রহের কোনো কমতি তার থাকার কথা না। তার বর্তমান অবস্থা জানতে হলে এখন একজন ইউরোলজিস্ট দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে।
যা বলছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বললে তারা ঢাকা পোস্টকে জানান, ঘটনার বিষয়টি তারা অবগত আছেন। কিন্তু ঘটনার সত্যতা নিয়ে তারা একটু দ্বিধায় আছেন।
স্বরমুশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য মো. উজ্জল মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনা শুনেছি, মেয়ের বাবা একবার ফোন দিয়েছিলেন। তবে কেউ এখন পর্যন্ত অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে আসেনি। এক পক্ষ বলছে ধর্ষণ হয়েছে, আরেক পক্ষ বলছে হয়নি। এখন বোঝা কঠিন আসল ঘটনা কী ঘটেছে। তবে তারা ঘরোয়াভাবে যদি সমাধানে যেত তাহলে ভালো হতো।
স্বরমুশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যন মো. আব্দুস সাত্তার জানান, ঘটনা শুনেছি, তবে কেউ বলছে সত্য, কেউ বলছে মিথ্যা। ওরা ডিএনএ টেস্ট করতে দিছে, তার রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে। মামলা হয়েছে এটাও শুনেছি। কিন্তু দুই পক্ষের কেউই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে আমি বিষয়টি অবগত আছি।
যা বলছে পুলিশ
নেত্রকোণা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এপ্রিলের ২৪ তারিখে আটপাড়া থেকে একটা অভিযোগ পাই যে, সুতারপুর এলাকায় একটা সাত বছরের মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠাই এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। পুলিশ ঘটনাস্থল তদন্ত করে এসেছে। মামলা নেওয়া হয়েছে। আসামি ধরার জন্য অভিযান অব্যাহত আছে। এ ধরনের ঘটনাগুলো নলেজে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করি। মামলা হওয়ার পর থেকেই আসামি পলাতক রয়েছে। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব।
আরএআর